সর্বশেষ

অমর একুশে বইমেলা ডিসেম্বরে, শঙ্কার মাঝে প্রস্তুতি লেখক-প্রকাশকদের

প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৬
“একুশের আবেগ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে যুক্ত। ডিসেম্বরে করলে একুশে বইমেলার ঘ্রাণ পাওয়া যাবে না।”
অমর একুশে বইমেলা ডিসেম্বরে, শঙ্কার মাঝে প্রস্তুতি লেখক-প্রকাশকদের

জাতীয় নির্বাচন ও রমজানের কারণে আগামী বছরের অমর একুশে বইমেলা নির্ধারিত সময়ের দেড় মাস আগেই শুরু হচ্ছে। বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে এই বইমেলা। তবে এ সিদ্ধান্তে লেখক-প্রকাশকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, প্রস্তুতির সময় কম থাকায় সৃজনশীল বই প্রকাশে সমস্যা হবে; আবার কেউ মনে করছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ও রমজানের কারণে মেলা আয়োজন কঠিন, তাই আগেভাগেই আয়োজন বাস্তবসম্মত।

 

প্রস্তুতি সংকট: প্রকাশক-লেখকদের অভিযোগ

 

সাধারণত অক্টোবরের শেষ থেকে প্রকাশকেরা মেলার জন্য বই ছাপার কাজ শুরু করেন। কিন্তু এবার সময় অনেক কমে এসেছে। প্রকাশকদের অভিযোগ, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ছাপাখানায় ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ও পাঠ্যপুস্তক ছাপার ব্যস্ততা থাকে, ফলে সৃজনশীল বই ছাপার চাপ দ্বিগুণ হবে। বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর দাশ বলেন, “নভেম্বর মাসে প্রেসে প্রচুর কাজ থাকে, তাতে বই ছাপা জটিল হয়ে উঠবে।”

 

অন্যদিকে, ছাপাখানা মালিকরাও বলছেন, ডায়েরি-ক্যালেন্ডারের অর্ডারের ভিড়ে বই ছাপার কাজ চাপ সৃষ্টি করবে। আধুনিক আলিফ বুক বাইন্ডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মাহিন মিয়া জানান, “প্রকাশকদের বলেছি, বই আগেভাগে পাঠান। ডিসেম্বর এলে চাপ সামলানো কঠিন হবে।”

 

 

তবে কাগজের সংকট হবে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। নয়াবাজারের কাগজ ব্যবসায়ী অসীম আচার্য্য জানান, “বাজারে পর্যাপ্ত কাগজ আছে, দামও আগের তুলনায় কম।”

 

ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক?

 

অনেক লেখক মনে করছেন, ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ডিসেম্বরে বইমেলা আনা হলে এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ হবে। শিশু সাহিত্যিক জুলফিকার শাহাদাৎ বলেন, “একুশের আবেগ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে যুক্ত। ডিসেম্বরে করলে একুশে বইমেলার ঘ্রাণ পাওয়া যাবে না।”

 

গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী মন্তব্য করেন, “মেলা গভীর শীতে হবে, যা আমার কাছে ইতিবাচক। তবে ফেব্রুয়ারির তারিখই ঐতিহ্য বহন করে।”

 

কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “নির্বাচনের আবহে নিরাপত্তা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতেই মেলা হলে ভালো হতো।”

 

প্রকাশকদের বাস্তবতা

 

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি (বাপুস) জানিয়েছে, তারাই তিনটি প্রস্তাব দিয়ে ছিল— ডিসেম্বর, জানুয়ারি বা নির্বাচনের পর। পরে বাংলা একাডেমি ১৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়।

 

অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নিরাপত্তাজনিত জটিলতা তৈরি হতো। তাই ডিসেম্বরে আয়োজন ভালো সিদ্ধান্ত।” তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রস্তুতির সময় কমে গেছে।

 

বাতিঘরের দীপঙ্কর দাশ মনে করেন, “মেলা ফেব্রুয়ারির আগে করাটা বাস্তবসম্মত। তবে ডিসেম্বর নয়, জানুয়ারিতে করলে ভালো হতো।”

 

 

সূচীপত্র প্রকাশনীর প্রকাশক সাঈদ বারী একে ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করে বলেন, “একুশে বইমেলার ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা আছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে প্রকাশকদের মূল সংগঠনগুলোর মতামত ছাড়া।”

 

লেখক সমাজের প্রতিক্রিয়া

 

কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “বাজার খারাপ থাকায় নতুন বই প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে না। এবার মেলায় এক-চতুর্থাংশ বইও বেরুবে না।”

অধ্যাপক সৈয়ব জিবরান জানান, “এই মেলার জন্য বই করছি না। বইমেলা সংস্কৃতির অংশ, ব্যবসায়িক মেলা নয়।”

 

তবে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বলেন, “মেলা না হওয়ার চেয়ে অসময়েই হোক, সেটাই ভালো। নির্বাচন ঘিরে মাঠ গরম হওয়ার আগে মেলা শেষ হয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত।”

 

অমর একুশে বইমেলা শুধু বই বিক্রির আয়োজন নয়, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের অংশ। নির্বাচনের কারণে মেলার তারিখ এগিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে কেউ বাস্তবতার প্রতিফলন, আবার কেউ ঐতিহ্যবিরোধী বলছেন। সময় কম থাকলেও লেখক-প্রকাশকদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই এবারও মেলায় আসবে সে প্রত্যাশা কারো কারো।

সব খবর