১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর—বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ। রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সর্বাত্মক অগ্রযাত্রা, কূটনৈতিক ক্ষেত্রের দ্রুত পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধে উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ের পথ প্রায় নিশ্চিত হয়ে ওঠে এই দিনে।
দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন: ‘কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা মুক্ত হবে’
এই দিনে দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশ মিশন। অনুষ্ঠানে মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কণ্ঠে ছিল মুক্তির দৃঢ় ঘোষণা, ‘আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা মুক্ত হবে। ঢাকার পতনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভূমি মুক্ত হবে।’
তিনি জানান, পাকিস্তান যদি ভারতের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তবে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও যুদ্ধ চালাতে প্রস্তুত।
ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হুমায়ুন চৌধুরী বলেন, মুজিবের মন বাঙালির সঙ্গে, আর বাঙালির মন তাঁর সঙ্গে; কোনো শক্তিই এ বন্ধন ভাঙতে পারবে না।
একই দিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতির পর এটিই ছিল প্রথম বৈঠক। মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন, খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে ভারতের সহায়তায় একটি ১২ সদস্যের আইএএস লিয়াজোঁ দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
ভারতের অবস্থান: ‘আঘাত এসেছে আমাদের ওপর—এবার পাল্টা আঘাত করছি’
লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে অবাস্তব বলে প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, ‘এতদিন আমাদের ওপর আঘাত এসেছে, এবার আমরা পাল্টা আঘাত করছি।’
রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম আলাদা বক্তব্যে পাকিস্তানের নৃশংসতার নিন্দা করে জানান, যশোর–সিলেট–কুমিল্লা অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী দ্রুত ভেঙে পড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ১২ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্নায়ুযুদ্ধ: সপ্তম নৌবহর বনাম সোভিয়েত রণতরী
পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত দেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে পাঠানোর নির্দেশ দেন যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় নৌ-অবরোধ ব্যর্থ করা এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা।
জবাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২০টি রণতরী ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করে। নিউইয়র্কে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন বলেন বাংলাদেশ সংকটের জন্য ভারত নয়, পাকিস্তানই দায়ী।
রণাঙ্গনে চূড়ান্ত অগ্রযাত্রা: নদী–আকাশ–স্থলপথে যৌথ বাহিনীর অভিযান
মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় জানান, ‘আমরা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’
যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঢাকার দিকে ঘেরাও আরম্ভ করে। টাঙ্গাইলে ৭০০ ছত্রীসেনা নামানো হয়।
উত্তরে ময়মনসিংহ–কুষ্টিয়া, পূর্বে আশুগঞ্জ–দাউদকান্দি, পশ্চিমে মধুমতি নদী ঘিরে অগ্রযাত্রা জোরদার হয়। ভারতীয় সেনাপ্রধান মানেকশ পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে কঠোরভাবে বলেন, ‘বাঁচতে চাইলে অস্ত্র নামাও, অন্যথায় মৃত্যু নিশ্চিত।’
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে পাক জেনারেল নিয়াজী প্রথমবারের মতো রাওয়ালপিন্ডিতে সাহায্য চাইতে বার্তা পাঠান।
দেশব্যাপী মুক্তাঞ্চল: কপিলমুনি, কুমারখালী থেকে নেত্রকোনা—চতুর্মুখী প্রতিরোধ
৯ ডিসেম্বর দেশের বহু অঞ্চল পাকিস্তানি দখলমুক্ত হয়। উল্লেখযোগ্য অঞ্চলগুলো হল-
গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, খুলনার কপিলমুনি, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস, গাজীপুরের শ্রীপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও নাজিরহাট, ময়মনসিংহের ত্রিশাল–গফরগাঁও–ঈশ্বরগঞ্জ, শেরপুরের নকলা।
কপিলমুনি:
চার দিনের ভয়াবহ যুদ্ধ শেষে ১৫৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। স্থানীয় জনগণের রায়ে গণআদালত তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং তা তাৎক্ষণিক কার্যকর হয়।
আশুগঞ্জ:
মিত্র ও ‘এস’ ফোর্সের সঙ্গে পাক বাহিনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১৪০ পাকিস্তানি সেনা নিহত, ৪০ জন মিত্রবাহিনীর সদস্য শহীদ হন।
জামালপুর–শেরপুর:
ভারতীয় বিমান হামলার পর জামালপুরে ৬০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
কুমারখালী:
রাজাকার ফিরোজ বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধ ভেঙে শহর মুক্ত হয়।
ত্রিশাল:
আফসার বাহিনীর আক্রমণে রাজাকাররা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
চট্টগ্রাম:
নাজিরহাট–বেতবুনিয়ায় তুমুল লড়াইয়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
হানাদারদের নৃশংসতা: পরাজয় সামনে এলেও বর্বরতা থামেনি
রাজশাহীতে পাকিস্তানি বাহিনী ছাত্র শওকত রেজাসহ চারজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। ৯ মাস জুড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলকে তারা বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে।
শেষ প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে: ভয় পেয়ে পালাতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত আক্রমণের খবর পেয়ে ৯ ডিসেম্বর রাতেই পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়, সেখানে উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।
টাঙ্গাইলে কৃষিফার্ম এলাকায় এমবুশে তিন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেও পাকিস্তানি বাহিনী ময়মনসিংহের দিকে পালাতে বাধ্য হয়।
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল এমন এক দিন যেদিন কূটনৈতিক মঞ্চ, আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও রণাঙ্গন—সব ক্ষেত্রেই পাকিস্তান স্পষ্টভাবে পরাজয়ের দিকে ধাবিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস, মিত্রবাহিনীর দ্রুত অগ্রগতি, বিশ্ব রাজনীতির পটে নতুন মেরুকরণ—সব মিলিয়ে এই দিনেই বিজয় ছিল প্রায় নিশ্চিত।