সর্বশেষ

ডাকসু নির্বাচন

সাজানো মঞ্চ, নির্ধারিত বিজয়?

প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১:০৩
সাজানো মঞ্চ, নির্ধারিত বিজয়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন প্রত্যাশার জোয়ার, তেমনি দেখা দিয়েছে আশঙ্কার ঘন মেঘ। নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষার্থীরা প্রাণবন্ত প্রচারণায় ব্যস্ত, পোস্টার-ফেস্টুনে ভরে গেছে ক্যাম্পাস। কিন্তু সাম্প্রতিক আদালতের নাটকীয় হস্তক্ষেপ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছু সিদ্ধান্তে ক্রমশই সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে এ মঞ্চ আসলে কি আগেই সাজানো, নির্দিষ্ট একটি পক্ষকে বিজয়ী করার জন্য?

 

হাই কোর্টে একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ডাকসু নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায় গতকাল। অভিযোগ ছিল, শিবির-সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ পূর্বে ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলেন। এ বিতর্কের জেরে যখন আদালত পুরো নির্বাচনই স্থগিত করে, তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ে ক্যাম্পাস। পরে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত সেই আদেশ স্থগিত করলে আপাতত ভোটের পথ খুললেও শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে—শেষ পর্যন্ত কি ভোট সত্যিই হবে, আর হলেও তা কতটা নিরপেক্ষ হবে?

 

এদিকে শিক্ষার্থীদের স্লোগান “ডাকসু আমার অধিকার, এই অধিকার দিতে হবে”, স্পষ্টতই প্রমাণ করে ডাকসুকে তারা শুধু নির্বাচন হিসেবে নয়, বরং অধিকারের সংগ্রাম হিসেবেই দেখছে।

 

কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন ছবি আঁকছে। প্রচার-প্রচারণার সময়সীমা মাত্র ১৩ দিন, অথচ ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর এক-তৃতীয়াংশই হয়তো ভোটে অংশ নিতে পারবে না। কারণ, ৫-৯ সেপ্টেম্বর টানা ছুটি এবং তারপর পরীক্ষার সূচি শিক্ষার্থীদের বিশেষত অরাজনৈতিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। এতে প্রশ্ন উঠছে—এমন সিদ্ধান্ত কি কেবলই কাকতালীয়, নাকি এটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ? কারণ, কথিত আছে আবাসিক হলগুলোতে ছাত্র শিবিরের ব্যাপক আধিপত্য ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপটে। সেক্ষেত্রে লম্বা ছুটিতে অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের বেড়াতে চলে যাওয়া কিংবা অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে না আসা শুধু ছাত্র শিবিরকেই লাভবান করবে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

 

নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রচারণায়ও বড় বাধা থেকে যাচ্ছে। অনেক হলে নারী প্রার্থী ছাড়া পুরুষ প্রার্থীরা ঢুকতে পারছেন না, ফলে নারী শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই কার্যত প্রচারণা থেকে বিচ্ছিন্ন। অথচ, অথচ ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠনগুলো ধর্মীয় মোড়কে হলগুলোতে অবাধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এটিকে প্রশাসনিক পক্ষপাত হিসেবেই দেখছেন অধিকাংশ প্রার্থী।

 

রাজনীতির মঞ্চে এই অসামঞ্জস্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বাড়াচ্ছে। একদিকে আদালতের নাটকীয় স্থগিতাদেশ, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিতর্কিত পদক্ষেপ—সব মিলিয়ে সন্দেহ জাগছে, ডাকসুর মতো একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন কি কেবল আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? ছাত্রসমাজকে নিরুৎসাহিত করে কি নির্বাচনকে নির্দিষ্ট একটি পক্ষের অনুকূলে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে?

 

কেউ কেউ বলছে, আদালতের রিট, হঠাৎ ছুটি, নারী শিক্ষার্থীদের সীমাবদ্ধতা সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনের মাঠই সাজানো হচ্ছে শিবিরের নিশ্চিত বিজয়ের জন্য।

 

ডাকসু নির্বাচনের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে জরুরি হলো স্বচ্ছতা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। অন্যথায় এই নির্বাচন প্রমাণ করবে বাংলাদেশের রাজনীতির মতো বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিও এখন সাজানো মঞ্চে রূপ নিয়েছে, যেখানে ফলাফল আগে থেকে নির্ধারিত।

 

ডাকসু নির্বাচন একদিনের ভোট নয়, এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ। কিন্তু যদি শিক্ষার্থীরাই বিশ্বাস হারায় যে তাদের ভোটে পরিবর্তন আসবে না, তবে এটি হবে আমাদের শিক্ষাঙ্গনের জন্য এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।

সব খবর