এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর এক উত্তাল সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে কেন ফলাফলের গ্রাফ এতটা নিম্নমুখী? দুই দশকের মধ্যে প্রথমবার এইচএসসিতে পাসের হার নেমেছে এত নিচে। ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। তখন থেকেই প্রায় প্রতিবার পাসের হার কিছুটা ওঠানামা করলেও সাধারণভাবে তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। কিন্তু এবারে তা ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশে নেমেছে অর্থাৎ পরীক্ষার্থীর প্রায় ৪৩ শতাংশই পাস করতে পারেনি। এছাড়া জিপিএ–৫ প্রাপ্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান সংখ্যা হঠাৎ সংকুচিত হয়েছে, এবং একাধিক কলেজ থেকে কেউই পাস করেনি। এইসব তথ্য দেখে বোঝা যায় শিক্ষা ব্যবস্থায় কোথাও একটা গলদ আছে, সেটি সহজভাবে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।

এই বছরের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৪২ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৬ জন পাস করেন। ফলে গড় পাসের হার দাঁড়ায় ৫৭.১২ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ পয়েন্ট কম।
জিপিএ–৫ প্রাপ্তির দিক থেকেও ফল খারাপ। গত বছর ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন পেয়েছিলেন, এ বছর মাত্র ৬৩ হাজার ২১৯ জন। অর্থাৎ মাত্র অর্ধেকেরও কম।
শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান ছিল ১,৩৮৮টি, যা বর্তমানে নেমে এসেছে মাত্র ৩৪৫–এ। অন্যদিকে, গত বছর যেখানে ৬৫টি প্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করেনি, এবার সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০২। এসব তথ্য ঘোষণা করেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি প্রফেসর খন্দোকার এহসানুল কবির।
তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা কাউকে ছক বেঁধে দিইনি, কোনো ওভারমার্কিং করার নির্দেশই নেই। প্রশ্নোত্তর মূল্যায়ন সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিয়ম মোতাবেক করা হয়েছে। তবে, এই যে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করল না এই হিসেব আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গলদ আছে, অবশ্যই গলদ আছে।”
শিক্ষা উপদেষ্টা একটি বিজ্ঞপ্তিতে লেখেন, “পাশের হার এবং জিপিএ–৫–এর কম হওয়া বিস্ময়কর নয় কারণ শেখার ঘাটতি শুরু হয় খুব সূচনা থেকেই; কিন্তু আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে সেই ঘাটতিকে আড়াল করার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি। পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক বানিয়ে তুলেছি, জিপিএ–৫–এর সংখ্যা তৃপ্তির মানদণ্ড, ফলেই মূল সমস্যাগুলি লুকিয়ে ছিল।”
বোর্ডভিত্তিক চিত্র
কুমিল্লা বোর্ডঃ সর্বনিম্ন পাস
কুমিল্লা বোর্ডের অধীন ৪৫৫টি প্রতিষ্ঠান থেকে ৯৯,৫৭৬ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেন, যার মধ্যে উত্তীর্ণ হন ৪৮,৬৫৭ জন। পাসের হার দাঁড়ায় মাত্র ৪৮.৮৬ শতাংশ।
জিপিএ–৫ প্রাপ্তি: ২,৭০৭ জন, যার মধ্যে মেয়েরা ১,৭৪৯ জন। মেয়েরা এই পাসের হার ও জিপিএ–৫–এ ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে।

কর্মকর্তারা বলছেন, ইংরেজি, উচ্চতর গণিতসহ কয়েকটি বিষয় পড়াশোনায় দুর্বলতা, শিক্ষকের অভাব ও অনুপস্থিতি এসব বোর্ডে ফলের অবনতির পেছনে বড় কারণ।
ময়মনসিংহ বোর্ড
এই বোর্ডে পাসের হার ৫১.৫৪ শতাংশ, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ১৫টি কলেজ এমন, যেখানকার কেউই পাস করতে পারেনি। এই রকম কলেজগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা কম হলেও, এরকম ঘটনা মারাত্মক শিক্ষা সংকেত বলে মুল্যায়ন করছেন বিশ্লেষকরা।

সিলেট বোর্ড
পাশের হার ৫১.৮৬ শতাংশ, যা বোর্ডের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। জিপিএ–৫ পেয়েছেন ১,৬০২ জন।

মেয়েরা আবার এগিয়ে পাসের হার ও জিপিএ–৫–এ বেশি সংখ্যায়।
বিভিন্ন বিভাগে ফলাফল:
এই বোর্ডে চারটি কলেজ এমন, যেখানে একজনও পাস করেনি।
রাজশাহী বোর্ড
পাশের হার কমেছে প্রায় ২১.৮৪ শতাংশ, দাঁড়িয়েছে ৫৯.৪০ শতাংশ। মানবিক বিভাগের ছেলেদের পাস হার মাত্র ৪১.৫১ শতাংশ। জিপিএ–৫ পেয়েছেন ১০,১৩৭ জন, যার অধিকাংশই মেয়ে।

এক বিষয়ে অকৃতকার্য ছাত্রসংখ্যা বেড়েছে, ১৭টি কলেজ থেকে কেউ পাস করেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অনিয়ম, বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে অবকাঠামোগত দুর্বলতা এ বোর্ডে ফলকে প্রভাব ফেলেছে।
দিনাজপুর বোর্ড
পাশের হার ৫৭.৪৯ শতাংশ, যা গত ছয় বছরের মধ্য সর্বনিম্ন। প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ৬৬৬, পরীক্ষার্থী ১,০৫,৮৯১। পাস করেছেন ৬০,৮৮২ জন, অকৃতকার্যে পড়েছেন ৪৫,০০৯ জন। ৪৩টি কলেজ, যেখানকার কেউই পাস করেনি এটি প্রকাশ করে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও শিক্ষার উঠে পড়ার দুই ধরনের সংকট।

অন্য বোর্ড
ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৬৪.৬২%, বরিশালে ৬২.৫৭%, চট্টগ্রামে ৫২.৫৭%, যশোর ৫০.২০%। মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার সবচেয়ে বেশি ৭৫.৬১%, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৬২.৬৭%।
কারণ ও বিশ্লেষণ
শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের পর্যবেক্ষণ ও মতামতের ভিত্তিতে এই দুর্যোগের যেসব কারণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে তারমধ্যে অন্যতম-
ভাবনা ও ভবিষ্যতের পদক্ষেপ
এই ফলাফল শুধু একবারের ব্যর্থতা নয় এটি শিক্ষা ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের সংকটের প্রতিফলন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ড, প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকজীবিংকে মিলেই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
কিছু সুপারিশ হতে পারে:
১. শিক্ষক উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ: কঠিন বিষয়গুলোর শিক্ষক দক্ষতা বাড়ানো।
২. শ্রেণিকক্ষ মনিটরিং: ছাত্রদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৩. অভিভাবক ও স্থানীয় অংশগ্রহণ: পরিবারের ও সমাজের ভূমিকা বাড়ানো যাতে ছাত্রদের সময় ও উৎসাহ পাওয়া যায়।
৪. গুণগত মূল্যায়ন ও প্রশ্নপত্র সংস্কার: শুধুই কঠিন প্রশ্ন দিয়ে নয় বেস পাঠ্য বিষয় ও বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান যাচাই।
৫. সমন্বিত পাঠক্রম ও সহায়তা কর্মসূচি: দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাস, টিউটরিং, পাঠ্য সহায়তা।
৬. নিদানমূলক মূল্যায়ন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বোর্ড পর্যায়ে ফলাফল বিশ্লেষণ ও দুর্বল অংশের পুনর্বিচার।