বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে চাল, তেল, ডাল, ডিম, পেঁয়াজ, সবজি ও চিনিসহ প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, ওষুধ, সাবান, শ্যাম্পু ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের দামও হু-হু করে বাড়ছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে।
এক বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানায়, ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় মোটা চালের কেজি ছিল ৫০-৫৪ টাকা, এক বছর পর ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০-৬২ টাকায়। খোলা আটার কেজি ৪০-৪৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০-৫৪ টাকা। সয়াবিন তেলের লিটার ১৪৫-১৫৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৭৬-১৭৮ টাকা। বড় দানার মসুর ডাল ১০৫-১১০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১২০-১৩৫ টাকা।
দেশি পেঁয়াজের দাম এক বছরে ১১০-১২০ টাকা থেকে নেমে ৭০-৮০ টাকায় এলেও চিনির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০-১৭০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১২৫-১৩৫ টাকা। ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামও বেড়েছে। শুধু আলুর দাম তুলনামূলকভাবে কিছুটা কমেছে।
অপরদিকে, ২০২২ সালে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, বর্তমানে তা ১১৮-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডলারের এ ঊর্ধ্বগতি আমদানি পণ্যের দামে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
উৎপাদন বেড়েছে, তবুও দাম বাড়ছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আলু, ডাল, ধান ও সবজি উৎপাদন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ২০২৪ সালে বোরো উৎপাদন ২ কোটি ৮৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে, ২০২৫ সালে তা ৩ কোটির বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবজি উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালের ২৯ লাখ টন থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে প্রায় ২ কোটি ৭৬ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।
অর্থাৎ উৎপাদন বাড়লেও বাজারে দাম কমছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল ভোক্তার কাছে পৌঁছায়নি। এর নেপথ্যে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা ও সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব দায়ী।
কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না
অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একাধিক কারণ একসাথে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে—
সরকারের উদ্যোগ
আওয়ামী লীগ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি দামে চাল, তেল, চিনি ও ডাল সরবরাহ করা এরমধ্যে অন্যতম। ৭০ লাখ পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হতো। আমদানি করা কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছিল। তবে এসব উদ্যোগের বাইরে অন্তর্বর্তী সরকার বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চাঁদাবাজি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন জরুরি বৈঠক করেছেন। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার সিন্ডিকেট ভাঙতে উদ্যোগের কথা বলেছেন। তবে কার্যকারিতার অভাবে সাধারণ মানুষ বাজারে তেমন স্বস্তি পাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, সব লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করা এবং বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ভোক্তা সমিতি (ক্যাব) বলছে, সরকারি সংরক্ষণাগার বাড়ানো এবং অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম নজরদারিতে আনতে হবে।
একদিকে উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে ডলার সংকট, সিন্ডিকেট ও দুর্বল বাজার তদারকির কারণে চাল, তেল, সবজি, ডাল ও ওষুধসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও সাধারণ মানুষের স্বস্তি ফিরছে না। ফলে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রকৃত দায়িত্ব কে নেবে?