সর্বশেষ

জীবনযাত্রায় ভয়ানক চাপ

আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে, সংকটে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত

প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:২৫
আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে, সংকটে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত

দেশের অর্থনীতি এখন বহুমাত্রিক চাপের মুখে পড়েছে। টানা তিন বছর ধরে শ্রমিকদের মজুরি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। খাদ্য, বাসাভাড়া, ওষুধ ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে। অনেকেই এখন সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন, কেউ কেউ ধার-ঋণ নিচ্ছেন টিকে থাকার জন্য।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গড় মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ০২ শতাংশ, যেখানে একই সময়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে শ্রমিকদের বাস্তব আয় হ্রাস পাচ্ছে। গত তিন মাস ধরে এই ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে—জুলাইয়ে মজুরি বৃদ্ধি ছিল ৮.১৯ শতাংশ, আগস্টে ৮.১৫ শতাংশ, আর সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮.০২ শতাংশে।

 

অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি শ্রমবাজারে এক ধরনের “নীরব সংকট”। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “শ্রমিকরা এখন দুই দিক থেকে আঘাত পাচ্ছেন। একদিকে দাম বাড়ছে, অন্যদিকে মজুরি বৃদ্ধির গতি কমছে। এটি যেন মাথা ও পায়ে একসঙ্গে আঘাত পাওয়ার মতো।”

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বলেন, “মজুরি বৃদ্ধির ধীরগতি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের দুর্বলতার প্রতিফলন। বিনিয়োগ কমছে, নিয়োগ কমছে, ফলে শ্রমের চাহিদাও কমছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলছে।”

 

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে

 

বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে, যা আগস্টের ৮ দশমিক ২৯ শতাংশের তুলনায়ও বেশি। খাদ্য, ভাড়া, ওষুধ, শিক্ষা ও পরিবহন খরচ—সব ক্ষেত্রেই লাগামহীন বৃদ্ধি ঘটছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, দেশে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা এক বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৩৬ লাখে।

 

একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “আগে মাসে যা খরচ হতো, এখন একই জিনিস কিনতে লাগে দেড়গুণ টাকা। আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয় প্রতিদিন বাড়ছে।”

 

প্রবৃদ্ধি কমছে, বিনিয়োগ স্থবির

 

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশে যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আইএমএফও তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৫ দশমিক ৪ থেকে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে এনেছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। উচ্চ সুদহার, ঋণ সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে নতুন প্রকল্প শুরু হচ্ছে না। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “উচ্চ সুদ ও অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে। নির্বাচনের পর স্থিতিশীলতা ফিরলে বিনিয়োগে গতি আসবে।”

 

বিদেশি বিনিয়োগ ও রফতানিতে ধস

 

২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিদেশি বিনিয়োগ ৬২ শতাংশ কমেছে। নতুন বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, যেখানে এক বছর আগে তা ছিল ২১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দেশের পণ্য রফতানি টানা দুই মাস কমেছে, আগস্টে ৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য ও পাটজাত পণ্যে ধস নেমেছে।

 

কর্মসংস্থান সংকুচিত, সঞ্চয় কমছে

 

বিবিএসের শ্রমবাজার জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারত্বের হার এখন ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২৭ লাখ মানুষ বেকার। তরুণদের মধ্যে এ হার আরও বেশি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আয় কমে যাওয়ায় মানুষ সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছে। ২০২৫ সালের আগস্টে সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেমে এসেছে মাত্র ২৮৯ কোটি টাকায় যা গত বছরের তুলনায় ৮৮ শতাংশ কম।

 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “মানুষের হাতে বাড়তি টাকা নেই, ফলে সঞ্চয় হ্রাস পাচ্ছে, যা সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাপনাতেও চাপ তৈরি করছে।”

 

দারিদ্র্য ও সামাজিক চাপ

 

বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট ২০২৫’ অনুযায়ী, চলমান সংকটে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। বিবিএস বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে।

 

সিপিডির অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগ স্থবিরতা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে ধ্বংস করছে। এখন সুশাসন ও লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা ছাড়া পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব নয়।”

 

অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য সহায়তা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি না করলে অর্থনীতি এক গভীর সামাজিক সংকটে নিমজ্জিত হতে পারে।

সব খবর

আরও পড়ুন

নীতিগত সংকট ও বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় বিপর্যস্ত গার্মেন্টস খাত

১২ মাসে ১৮২ কারখানা বন্ধ, কর্মসংস্থানে ধস নীতিগত সংকট ও বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় বিপর্যস্ত গার্মেন্টস খাত

নাজুক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চলতি ব্যয় মেটাতেও ঋণের ওপর নির্ভরশীল

তীব্র অর্থ সংকটে অন্তর্বর্তী সরকার নাজুক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চলতি ব্যয় মেটাতেও ঋণের ওপর নির্ভরশীল

সংকোচনমুখী মুদ্রানীতিতে বিপর্যয়ে বেসরকারি খাত

ভোটের আগে অর্থনীতিতে সতর্কতা সংকোচনমুখী মুদ্রানীতিতে বিপর্যয়ে বেসরকারি খাত

কোভিডকালের চেয়েও নিচে নেমে গেছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি

অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্য অনাস্থা কোভিডকালের চেয়েও নিচে নেমে গেছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি

ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে আইসিএসআইডি-তে এস আলম গ্রুপের সালিশি আবেদন

ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে আইসিএসআইডি-তে এস আলম গ্রুপের সালিশি আবেদন

ড. ইউনূসের বিশেষ সহকারী ও উপপ্রেস সচিবের বক্তব্যে বিজিএমইএ’র তীব্র প্রতিবাদ

পোশাক শিল্পকে ‘অবমূল্যায়ন’ ড. ইউনূসের বিশেষ সহকারী ও উপপ্রেস সচিবের বক্তব্যে বিজিএমইএ’র তীব্র প্রতিবাদ

যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’  ১৮ হাজার কর্মীর বোঝা সামলানো প্রধান চ্যালেঞ্জ

যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ ১৮ হাজার কর্মীর বোঝা সামলানো প্রধান চ্যালেঞ্জ

৭৮ শতাংশ পোশাক শ্রমিক পর্যাপ্ত খাদ্য জোগাতে পারেন না

বিএলএফের গবেষণা ৭৮ শতাংশ পোশাক শ্রমিক পর্যাপ্ত খাদ্য জোগাতে পারেন না