বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী চা-শিল্প বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা, তদারকি ও বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের বহু চা-বাগান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের বাগানগুলো মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মালিক ও কর্মকর্তারা।
২০২৪ সালে দেশের চা-উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৩ মিলিয়ন কেজি, কিন্তু উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৯৩.৩ মিলিয়ন কেজি। এর আগের বছর ২০২৩ সালে উৎপাদন হয়েছিল ১০২.৯২ মিলিয়ন কেজি, যা ছিল রেকর্ড। আবহাওয়ার খরার প্রভাবে উৎপাদন কমে গেলেও জুন-আগস্টের বৃষ্টিতে কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
তবে প্রকৃত সংকট আরও গভীর। গত পাঁচ বছর ধরে আলোচিত সিন্ডিকেটের কারণে নিলাম বাজারে চায়ের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার প্রতি কেজি চায়ের মূল্য ২৪৫ টাকা নির্ধারণ করলেও সিন্ডিকেটের প্রভাবে তা কার্যকর হচ্ছে না। উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫৮.৩০ শতাংশ, অথচ একই সময়ে চায়ের দাম বেড়েছে মাত্র ৯.১৬ শতাংশ। ফলে লোকসান বাড়ছে, আর বাগান মালিকরা বলছেন, “চা-বাগানগুলো চিরতরে বন্ধ হওয়ার পথে।”
সিলেটের বুরজান ও মৌলভীবাজারের ফুলতলা চা-বাগান ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগুলো রক্ষায় পৃথক পরিচালনা কমিটি গঠন করে কোনোরকমে ‘করামিন ইনজেকশন’ দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। কোম্পানি দুটি ডিসেম্বর পর্যন্ত বাগান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।
চা-শ্রমিকদের রেশন, বেতন-ভাতা, আবাসনসহ নানা বিষয়েও সংকট প্রকট। শ্রমিকরা দাবি তুলেছেন, তাদেরকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাগানের ভূমি প্রদান করতে হবে। কিন্তু সরকার বলছে, সব চা-বাগানের মালিকানা সরকারের, যা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হয়েছে—ফলে আইনি ভিত্তিতে ভূমি হস্তান্তর সম্ভব নয়।
চা-শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে মালিকরা ১২ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছেন চা সংসদের চেয়ারম্যান বরাবর। এর মধ্যে রয়েছে—চা-শিল্পকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনা, সিলেটে নিলাম কেন্দ্র স্থাপন, রপ্তানি বাড়ানো, শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং মান নিয়ন্ত্রণহীন উৎপাদন বন্ধ করা।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন-সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জিএম শিবলী বলেন, “চা-বাগান মালিকদের আন্তরিকতায় এখনও সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।” চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইসমাইল হোসেন জানান, উৎপাদন ও গুণমান বৃদ্ধিতে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
দেশে বর্তমানে ১৬৭টি চা-বাগান রয়েছে, যার মধ্যে ১৩৭টি সিলেট অঞ্চলে। মৌলভীবাজারেই রয়েছে ৯২টি বাগান। দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে এই অঞ্চল থেকে। অথচ এই শিল্প আজ অস্তিত্ব সংকটে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, দেশের অন্যতম কৃষিভিত্তিক এই শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে।