বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে গভীর সংকটে। ব্যাংক খাত, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং শেয়ারবাজার—এই তিনটি প্রধান স্তম্ভেই ধস নেমেছে। খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্র, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং বাজারে জাঙ্ক কোম্পানির আধিপত্য অর্থনীতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ব্যাংক খাতে খেলাপির দুষ্টচক্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন ২০২৫ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও ৩.১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে যা আদালতে আটকে, অবলোপনকৃত বা স্থগিত। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ ৯ লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ সংজ্ঞা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত না করলে ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফিরবে না। ড. মইনুল ইসলাম বলেন, “কাগজে-কলমে খেলাপি কমালেও বাস্তবতা বদলায় না।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, সব খেলাপি ঋণ প্রকাশ করা হবে এবং আদায় কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
এশিয়ায় শীর্ষ খেলাপি দেশ
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (ADB) মতে, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের দেশ। ২০২৪ সালে মোট ঋণের ২০.২% খেলাপি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৮% বেশি। ADB বলছে, বাংলাদেশে “সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থা” বিরাজ করছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ভারতের মতো সাহসী সংস্কার ছাড়া এ সংকট কাটবে না।” সানেমের সেলিম রায়হান রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ ও বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছেন।
পাঁচ ইসলামি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে
ফার্স্ট সিকিউরিটি, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন দেবে। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৪৮–৯৮% পর্যন্ত।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেও সংকট
ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় কার্যত থেমে গেছে। শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে ৩১,৯০৮ কোটি টাকা বকেয়া থাকলেও আদায় হয়েছে মাত্র ২১৯ কোটি। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭০,৮৪৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৫%।
তবে জুলাইয়ে ব্যাংক আমানতে ৮.৪২% প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, যা আস্থা ফেরার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
দেউলিয়ার পথে এনবিএফআই খাত
২০টি সমস্যাগ্রস্ত এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণ ২১,৪৬২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৩%। ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৪ সালের শেষে এই খাতের মোট ঋণ ছিল ২৫,৮০৮ কোটি, যার মধ্যে জামানত মাত্র ২৬%।
শেয়ারবাজারে আস্থার সংকট
শেয়ারবাজার গত ১৬ বছরে ৩৮% সংকুচিত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বিনিয়োগকারীরা প্রতিবছর গড়ে ৩% মূলধন হারিয়েছেন। ডিএসই’র ৩৯৭ কোম্পানির মধ্যে ৯৮টির শেয়ার ১০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে, যার অর্ধেকের দাম ৫ টাকারও কম।
শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের কাজী মনিরুল ইসলাম বলেন, “এত শেয়ারের দর ফেস ভ্যালুর নিচে নামা কোম্পানিগুলোর দুর্বল পারফরম্যান্সের ইঙ্গিত।” ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “জাঙ্ক শেয়ার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। দুর্বল কোম্পানিগুলো বন্ধ বা একীভূত করে নতুন শক্তিশালী কোম্পানি আনতে হবে।”
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে এখন প্রয়োজন সাহসী সংস্কার, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। না হলে এই তিন স্তম্ভের ভাঙন আরও গভীর হবে।