নীলফামারীর বাণিজ্যিক উপজেলা সৈয়দপুরের রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস শিল্প বড় সংকটে পড়েছে। ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় এখানকার ঝুটভিত্তিক পোশাক রফতানি অর্ধেকে নেমে গেছে। ফলে হাজারো শ্রমিক ও উদ্যোক্তা আর্থিক বিপাকে পড়েছেন।
সৈয়দপুর রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক শিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এখানকার দুই শতাধিক কারখানায় ঝুট কাপড় থেকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি অর্ধেকে নেমেছে। আগে ট্রাউজার, শর্টস, জ্যাকেট, টি-শার্ট, জিনসসহ নানা ধরনের পোশাক স্থানীয় বাজার ছাড়াও ভারত, ভুটান ও নেপালে রপ্তানি হতো। এখন স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, সমুদ্রপথে রপ্তানি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে তিন গুণ, সময় লাগছে ২০-২৫ দিন। আগে স্থলপথে ২০ হাজার টাকায় পোশাক রপ্তানি করা যেত, এখন কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে একই পরিমাণ পণ্য পাঠাতে খরচ হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। ফলে অনেক উদ্যোক্তা ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন চালাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ স্থানীয় বাজারে পোশাক বিক্রি করে কোনোমতে টিকে আছেন।
সৈয়দপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ মনজুর হোসেন বলেন, “২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশ-বিদেশ মিলে ৪০ কোটি টাকার বেশি পোশাক বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে এবার বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে।” তিনি জানান, শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও কারিগররা সবাই লোকসানে পড়েছেন।
সৈয়দপুরে ঝুট কাপড়ের ব্যবসা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। ২০০২ সাল থেকে এর বিস্তার বাড়ে। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম থেকে ঝুট কাপড় সংগ্রহ করে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি-শার্টসহ নানা পোশাক তৈরি করেন। বর্তমানে অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার সরাসরি এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। অনেক বাড়িই ছোট কারখানায় পরিণত হয়েছে।
নয়াটোলা মহল্লার এইচ আর গার্মেন্টসের মালিক হামিদুর রহমান বলেন, “চলতি বছর মাত্র ৫০ লাখ টাকার অর্ডার পেয়েছি, অথচ আগে কোটি টাকার বেশি অর্ডার আসত। বিদেশে পাঠানো যাচ্ছে না বলে স্থানীয় বাজারে কিছু বিক্রি করছি।” নিয়ামতপুরের কারখানা মালিক রনো জানান, তার ৫০টি আধুনিক সেলাই মেশিনে উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন, অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন।
সৈয়দপুর রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক শিল্প সমিতির এক নেতা জানান, দুই শতাধিক কারখানায় পাঁচ-ছয় হাজার নারী-পুরুষ কর্মরত। ২০২৩ সালে শীত মৌসুমে ৪০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। এবার তা ২০ কোটিও হবে না। সাধারণ সম্পাদক শাহীন আক্তার বলেন, “কারখানাগুলো রেলের জমিতে গড়ে উঠায় ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায় না। ফলে ব্যবসায়ীরা অর্থ সংকটে টিকে থাকতে পারছেন না।”
ইনভেন্ট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মালিক হুমায়ুন কবির বলেন, “আমাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রায় শতভাগই ভারতে যায়। এখন কেবল কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে রপ্তানি করা যাচ্ছে। এতে খরচ তিনগুণ বেড়েছে, সময়ও বেশি লাগছে। ফলে রপ্তানি অন্তত ৫০ শতাংশ কমে গেছে।” আরেক রপ্তানিকারক ফরহাদ হোসেন বলেন, “নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে প্রায় ১৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকের অংশ বড়। বছরে প্রায় ৭০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয় ভারতে, যার ৯৩ শতাংশই স্থলপথে যায়। ফলে নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে।