রাজধানী ঢাকার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল এবং অভিজাত আবাসিক ও ব্যবসায়িক এলাকা গুলশান ও তেজগাঁও গত ছয় মাসে মব সহিংসতার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ছয় মাসে ঢাকায় সংঘটিত মোট ৩৮টি দাঙ্গার প্রায় তিন-চতুর্থাংশই ঘটেছে এই তিন বিভাগে।
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘনবসতি ও আর্থিক কার্যক্রমের কারণে মতিঝিল সবসময়ই আন্দোলন, অবরোধ ও ঘেরাওয়ের কেন্দ্রবিন্দু। গত ২৯ জুলাই ৩০–৩৫ জনের একটি মব মতিঝিলের একটি বাণিজ্যিক ভবন দখলের চেষ্টা করে। খবর পেয়ে পুলিশ গেলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে থানায় হামলার চেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মতিঝিল থানার ওসি মেজবাহ উদ্দিন জানান, এখানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত, ফলে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ায় উত্তেজনা তৈরি হয় এবং তা কখনো কখনো মব সহিংসতায় রূপ নেয়।
অভিজাত এলাকা গুলশানেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ মার্চ গুলশান-২ এ ৮১ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি ঘেরাও করে মব তৈরি হয়। ওই বাড়ির সাবেক তত্ত্বাবধায়ক শাকিল আহমেদ জনতাকে গুজব ছড়িয়ে উসকে দেন যে সেখানে ২০০–৩০০ কোটি টাকা লুকানো আছে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। ওই বাড়িটি ছিল আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর।
বারিধারার কূটনৈতিক জোনেও সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেছে। গত ২৭ জুন ক্যাপিটাল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাররম হোসেইন খানের বাসভবনে হামলা চালায় একদল মব। তারা ভাঙচুর ও লুটপাট করে এবং ফ্ল্যাট দখলের চেষ্টা করে। এ ধরনের ঘটনা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ডিএমপির হিসাব অনুযায়ী, মতিঝিলে সর্বোচ্চ ১৩টি দাঙ্গা, গুলশানে ৮টি এবং তেজগাঁওয়ে ৭টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে গত ছয় মাসে। এছাড়া এ সময় ২৩১টি দস্যুতার ঘটনা রেকর্ড হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫০টি তেজগাঁওয়ে। একই সময়ে রাজধানীতে ৫০৩টি জখমের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মতিঝিলে সর্বোচ্চ ১২৯টি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “মবের কারণে ব্যবসায়িক আস্থা কমে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সব ধরনের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হচ্ছে এবং কর্মসংস্থান তৈরির পথে বড় বাধা তৈরি হচ্ছে।”
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেনাল কোডে দাঙ্গা সংক্রান্ত ধারা থাকলেও মব অপরাধকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, সময়ের পরিবর্তনে নতুন ধরনের অপরাধ হিসেবে মবকে পেনাল কোডে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “গত বছরের তুলনায় মব সহিংসতা কিছুটা কমেছে। তবে মতিঝিল ও গুলশানের মতো এলাকায় অর্থসম্পর্কিত কারণে মব তৈরি হচ্ছে। পুলিশকে এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কমিউনিটির সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।”
সংশ্লিষ্টদের মতে, মব সহিংসতা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগ পরিবেশ আরও সংকটাপন্ন হবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্যোগ কমে আসবে এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। তাই বাণিজ্যিক ও অভিজাত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এখন সময়ের দাবি।