বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে হঠাৎ ফোন এলো এবং তিনি বললেন “আমি আপনাকে সৌদী আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ দিতে চাই, আপনি রাজী আছেন?” ফোনটি অপ্রত্যাশিত। কারণ আমি রাষ্ট্রদূত বা কোনো পদপদবির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কখনো অনুরোধ করিনি। এগুলো আমার মাথায় কখনো আসেনি।
ফোন যখন আসে তখন আমি নিউ ইয়র্কের একটি বাংলাদেশি হোটেলে মিটিং-এ ছিলাম। উনার কথাগুলো মাইকের আওয়াজে ঠিকমত শুনতে পারছিলাম না। তাই মিটিং থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে গিয়ে উনাকে বল্লাম “আমি তো কোনো ডিপ্লোমেট নই, আমি কি এই দায়িত্ব পালন করতে পারবো?” তিনি উত্তরে বললেন, “আপনি উটের দৌঁড়ে বাংলাদেশী শিশুদের জকি হিসাবে ব্যবহার বন্ধ করতে বিশ্বজুড়ে যে সফল অভিযান চালিয়েছেন, শিশু শ্রম বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে যে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায়ে যে কার্যকরী পদক্ষেপ রেখেছেন তা যেকোনো রাস্ট্রদূতের থেকে উত্তম।” আমি আমতা আমতা করে বললাম “ওগুলো তো মানবিক কাজ, আমাকে অনেকে সাহায্য করেছে, সুতরাং তা সম্ভব হয়েছে। সৌদী আরবে রাষ্ট্রদূত তো অনেক বড় দায়িত্ব, প্রায় বারো-তেরো লাখ প্রবাসী ওখানে আছে। এই দায়িত্ব সামাল দিতে পারবো কিনা জানি না। তাছাড়া ইয়েস বলার আগে আমার বস অর্থাৎ আমার গিন্নীর অনুমতি নিতে হবে।” প্রধানমন্ত্রী বললেন, “ওর অনুমতি আমি নিয়ে নেব।”
সারসংক্ষেপ অনুমোদন হবার পর দীর্ঘ ৪ মাস অপেক্ষা
আমি রাজি হলে উনি তখনই দেশে ফিরে এসে কাজে যোগদান করতে বললেন। আমি বললাম “এটা অসম্ভব। আমার ছেলেমেয়েরা, অর্থাৎ আমার ছাত্রছাত্রীরা মাত্র মিডটার্ম পরীক্ষা দিয়েছে, এদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আসতে পারবো না, মিনিমাম দুই মাস পর আসতে পারবে। মনে হয় মে মাসের শেষে আসতে পারবো।” তখন তিনি বললেন “আপনি দীপু মনির সাথে আলাপ করুন। আমি তাকে বলে রাখবো। তবে আমি চাইছিলাম আপনি এখনই জয়েন করেন।”
মে মাসের শেষে যখন ঢাকায় গেলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সাথে দেখা করলাম। তারপর অনুমোদিত ফাইল পাওয়া গেল না, আবার নতুন করে সার সংক্ষেপ প্রস্তুত হলো। নতুন করে অনুমোদন আসলো । কিন্তু কাজ অগ্রসর হয় না। এগ্রিমো আরবী ভাষায় পাঠাতে হবে, তা অনুমোদিত হয়ে আসতে হবে— জুন গেল, জুলাই মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, কোনো খবর নাই।
ইতিপূর্বে আমি কয়েক বছর সৌদীতে কাজ করেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিষয়ক পরামর্শক হিসাবে। দেখেছি গ্রীষ্মে ওরা ছুটিতে যায় এবং তখন রাজার কাছে নিতান্ত জরুরি ফাইল ছাড়া কিছুই পেশ করা হয় না। আমি আমার গিন্নীকে বললাম ইয়ার্ড সেল বন্ধ করো (সৌদীতে যাব বলে ইয়ার্ড সেল শুরু করেছিল) মনে হয় সৌদিতে যাওয়া হবে না। কারণ এরমধ্যে কিছু আদম ব্যবসায়ীরা ঢাকার পত্রিকাগুলোতে আমাকে সৌদী আরবে রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ না দিতে জোর তদবির চালাচ্ছেন। এছাড়াও আমার এক ঘনিষ্ঠ জন যিনি আমেরিকায় বসবাস করেন তিনিও আমাকে রাস্ট্রদূত হিসাবে সৌদীতে না যেতে পরামর্শ দিলেন। বললেন, “আপনার সৌদীতে রাস্ট্রদূত হিসাবে যাওয়াটা ঠিক হবে না।” উনাকে কেউ কেউ বলেছেন না যাওয়ার জন্য। আমি বললাম আমি তো চাকরি ছেড়ে যাবো না, ছুটি নিয়ে যাবো। আমার বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ছুটি দিবে।
এসব বেড়াজালে যখন মনে হচ্ছিল আমার মনোনয়নটা হয়তো কার্যকরি হচ্ছে না, সুতরাং বস্টনে ফিরে আসবো, এমন সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব এন আই খান আমাকে হুকুম দিলেন এক্ষুনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আসতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি জানালেন আমাকে জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি করে পাঠাবেন, সৌদীতে নয়। তিনি আরো বললেন, “মোমেন সাহেব, আমার দেশ পর পর পাচঁবার এক নম্বর দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, আমার দেশ তলাবিহীন ঝুড়ি হিসাবে পরিচিত, আপনি জাতিসংঘে যান এবং এসব বদনাম ঘুচাতে হবে।” তিনি যখন এগুলো বলছিলেন তখন তাঁর চোখ পানিতে জ্বলজ্বল করছিল, তাঁর কথাগুলো থেমে যাচ্ছিল। তিনি খুবই ইমোশনাল হয়ে পড়েন। দেশের প্রতি তাঁর যে গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ তা আমাকেও ইমোশনাল করে তোলে। শেখ হাসিনা যথার্থই দেশ প্রেমিক।
স্থায়ী মিশনে যোগদান ২০০৯ সাল
২০০৯ সালের আগস্ট মাসে আমি স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে বাংলাদেশ মিশনে যোগদান করি। জাতিসংঘে যোগদানের পর সৌভাগ্যক্রমে আমার অনেক পূর্ব পরিচিতদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তারা বিভিন্ন দেশের সিনিয়র ডিপ্লোমেট বা রাষ্ট্রদূত। এদের কেউ কেউ আবার আমার স্টুডেন্ট ছিল। শিক্ষকের প্রতি এদের শ্রদ্ধা অনেক। যদিও শিক্ষকদের বেতন বা আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়, তবে শিক্ষক হওয়ার এই একটি বিশেষ সুবিধা, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা বেশ সম্মান করে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ড. সূজান রাইস আমার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় উনি আমাকে খুব সাহায্য করেন। তাঁর কারণেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্যে ঘরোয়া পরিবেশে প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে নৈশভোজ যেখানে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন, কিংবা প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে একান্ত বৈঠক আয়োজন করা সম্ভব হয়। পরবর্তীতে এই সূজান রাইসের কারণে লেবাননে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি ড্রে্স্টোওয়ার, দুটি গানবোট এবং ৪৪১ জন পিস কিপিং নৌবাহিনীর সদস্যদের পাঠানো সম্ভব হয়।
উল্লেখ্য যে এইবারই প্রথম কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি বাংলাদেশ মিশনে এসে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রোগ্রামটি ফাইনাল করেন। তা দেখে আমার এক সিনিয়র ডিপ্লোমেট অবাক হয়ে বলেন “স্যার, এটাও সম্ভব! মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি আমাদের অফিসে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন”... ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘে আসা উপলক্ষ্যে ইতিমধ্যেই আমরা অনেকগুলো দেশের মিশনে রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে সাক্ষাৎ চেয়ে বিশেষকরে পি-৫— জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্য রাস্ট্রসমূহকে চিঠি দিয়েছি, তবে কেউই তখনো উত্তর দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘ সফর ফলপ্রসূ হয়
প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘের সফরটা খুবই ফলপ্রসূ হয়। এদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালে যাদের তিনি মন্ত্রিসভায় নিয়োগ দেন তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ না থাকায় আমার কাজটা অনেক সহজ হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার একাধিক ভালো ভালো কাজ করায় বাংলাদেশের দুর্নীতির বদনাম যেমন কমে, দেশের ভাবমূর্তি অনেক অনেক উজ্জ্বল হয়। যে জিনিসটা বলতে যাচ্ছিলাম তা হচ্ছে এই সর্ব প্রথম জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে বিজয় দিবস জনগণকে নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উদযাপন হয়।
স্থায়ী মিশনে সর্বপ্রথম বিজয় দিবস উদযাপন
১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। সুতরাং সিদ্ধান্ত নিলাম ঘটা করে বিজয় দিবস উদযাপন করবো। কিন্তু বেজায় মুশকিলে পড়লাম। আমার সহকর্মীরা জানালেন যে বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। বরাদ্দ আছে শুধুমাত্র ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের জন্য।
মনে মনে বললাম যে, যখন রাষ্ট্রদূত ছিলাম না, তখন আমরা সাধারণ নাগরিক হিসাবে সব সময়ই বিজয় দিবস ঘটা করে পালন করেছি। কেমব্রিজ শহরে আমাদের বন্ধুবর আব্দুল ওয়াহিদ সিনহা বা সান্টু সব সময়ই তার তন্দুর রেস্টুরেন্টে বিজয় দিবস পালনে সহায়তা করেছে। আর এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে বিজয় দিবস পালন করতে পারবো না তা কোনো মতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।
আমার বিষণ্নতা দেখে আমার সহধর্মিণী সেলিনা মোমেন বললেন তুমি কতজনকে ডাকতে চাও। বললাম কাকে বাদ দিয়ে কাকে বলি, সবাইকে বলতে হবে। সুতরাং প্রায় ২৫০-৩০০ জনের মতো হবে। তিনি বললেন তিনি ৩০০ জন লোকের জন্য ভূনা খিচুরি ও গরুর গোস্ত রান্না করে দিবেন। শোনে আমি মহা খুশী। তবে এত লোকের খাবার একা কীভাবে করবে তা নিয়ে সংকিত হই কারণ তখনো আমাদের কোনো রান্নার সহায়তা ছিল না। অফিসে গিয়ে সবাইকে বললাম খিচুরি ও গোস্ত আমার গিন্নি দিতে রাজি। দু-তিন জন সহকর্মী বললেন, তারা ড্রিংক নিয়ে আসবেন, প্লেট নিয়ে আসবেন, ইত্যাদি। কেউ কেউ বললেন তারা ডেজার্ট নিয়ে আসবেন। আমাদের কালচারাল মিনিস্টার অধ্যাপক মমতাজউদদীন সাহেব বললেন, খিচুরির সাথে ডিম হলে ভালো হয়। গিন্নিকে মমতাজ স্যারের ইচ্ছা জানালে তিনি বললেন তিনি ৪০০টি ডিমের ব্যবস্তা করবেন। পরবর্তীতে যারা গোস্ত খাবেন না তাদের কথা চিন্তা করে একটি সবজি আইটেম যোগ করা হয়।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এই সর্ব প্রথম বাংলাদেশ মিশনে বিজয় দিবস পালিত হলো। বিজয় দিবসে বাংলাদেশী জনগণ ছাড়াও প্রায় সাড়ে চারশো বা পাঁচশত জন বিভিন্ন দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, রাষ্ট্রদূত এবং ইউএন ডিপ্লোমেট যোগদান করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বন্ধুদেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা বক্তব্য রাখেন
এই প্রথম জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের মিশনে আসেন এবং তিনি ছাড়াও যে সমস্ত দেশ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করেছিল যেমন ভারত, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া— তাদের স্থায়ী প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। তাছাড়া যেসব বিদেশি সাংবাদিক এবং মার্কিন নাগরিকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন তাদের দু-তিনজন যুদ্ধকালীন দিনের কাহিনী তুলে ধরেন। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানটি খুবই সফল, ভিন্নধর্মী ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
সব মিশনে জাতীয় দিবসসমূহ পালনের সিদ্ধান্ত
ডিসেম্বরের শেষে ঢাকায় গেলে পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানালাম যে, আপনি আমাকে রাষ্ট্রদূত করেছেন তবে দেশের জাতীয় দিবসগুলো পালনের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ দেননি। নিজের পকেটের অর্থ দিয়ে তা আয়োজন করতে হয়। তখন তিনি মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে ডাকলেন এবং অর্থমন্ত্রী জানালেন যে কোন কোন জাতীয় দিবস আমি পালন করতে চাই এবং প্রতিটি দিবস উদযাপন বাবদ কত খরচ হবে তা উল্লেখ করতে হবে। তিনি আরো বললেন যে শুধুমাত্র তোমার মিশনের জন্য আমি কোনো বরাদ্দ দিতে পারবো না। তোমাদের কতটা মিশন আছে এবং সবগুলো মিশনে এই দিবসগুলো পালন করতে কত খরচ হবে তা উল্লেখ করে মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে আমার কাছে একটি ডিও পাঠাও এবং তখন বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার প্রত্যকেটি মিশনে বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, ৭ই মার্চ, ১৫ই আগস্ট এবং শিশু দিবস, ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বাজেট বরাদ্দ করে। ইতিপূর্বে শুধুমাত্র ২৬শে মার্চ বা স্বাধীনতা দিবস পালন বাবদ বরাদ্দ ছিল।
বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে বিজয় দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সকল মিশনে জাতীয় দিবসগুলো পালনের রীতি চালু হয়। তবে পরিতাপের বিষয় যে জাতীয় দিবসসমূহ পালনের মধ্য দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি, দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ইতিহাস বিদেশীদের কাছে তুলে ধরার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
লেখকঃ অধ্যাপক ড. এ কে আব্দুল মোমেন
প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি