বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনের লড়াই নয়; এটি ছিল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক প্রতিরোধের সম্মিলিত ঐতিহ্য। সেই প্রতিরোধের সবচেয়ে দৃশ্যমান অথচ প্রায়শই উপেক্ষিত অধ্যায়টি হলো চারুশিল্পীদের ভূমিকা। ক্যানভাস, রং, কালি, কাঠখোদাই, পোস্টার সবই হয়ে উঠেছিল বাঙালির চেতনা, প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের শক্তিশালী ভাষা।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই গড়ে ওঠে এই প্রতিরোধশিল্পের ভিত্তি। তখনকার তরুণ শিল্পীরা-আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, বিজন চৌধুরী, ইমদাদ হোসেনসহ অনেকেই সরাসরি জড়িত ছিলেন আন্দোলনের সাথে। প্রয়োজনের তাগিদেই আঁকা হয়েছিল অসংখ্য পোস্টার, ব্যানার, কার্টুন। এই প্রজন্মই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের চিত্রকলার প্রধান স্তম্ভ হয়ে ওঠেন। পঞ্চাশের দশক ছিল আমাদের শিল্প–সাহিত্যের আসল রেনেসাঁ। এখান থেকেই শুরু হয় সাংস্কৃতিক জাতিসত্তার নির্মাণ যার ধারাবাহিকতায় বাঙালির রাজনৈতিক জাগরণ একাত্তরের দিকে এগিয়ে যায়।
১৯৫৬ সালে শিল্পী হামিদুর রহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমেদের নকশায় শহীদ মিনার নির্মাণ শুরু হয়। খুব দ্রুতই এই স্মৃতিসৌধ পরিণত হয় শিল্পী–নেতৃত্বাধীন গণ–প্রতিবাদের কেন্দ্রস্থলে। বিশেষভাবে ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু হয় শহীদ মিনারভিত্তিক ব্যানার প্রদর্শনী, আলপনা, দেয়ালচিত্র যা রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে একুশে ফেব্রুয়ারির ‘স্বরবর্ণ ব্যানার প্রদর্শনী’ ছিল এক অনন্য শিল্পমুহূর্ত। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবী, হাশেম খানসহ অনেকে এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এই প্রজন্মের শিল্পীরা বুঝেছিলেন ভাষা ও শিল্পই হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক আন্দোলনের শক্তিশালী হাতিয়ার।

ঢাকা আর্ট কলেজ ছিল এই সাংস্কৃতিক জাগরণের কেন্দ্র। মিছিল, সভা সমাবেশে ব্যবহৃত ফ্রি পোস্টার, ব্যানার, দেয়ালচিত্র সবই তৈরি হতো আর্ট কলেজের ছাত্রদের হাতে। ৬ দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, ছাত্র–রাজনীতির প্রতিটি উত্তাল মুহূর্তে শিল্পীরা ছিলেন জনমত গঠনের সামনের সারির যোদ্ধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে প্রতিদিন বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো; পোস্টার, ফেস্টুন, কার্টুন, ব্যানারসজ্জিত মিছিল নিয়ে ছাত্ররা সমাবেশস্থলে হাজির হলে সারা কলাভবন প্রাঙ্গণ হাততালিতে ফেটে পড়ত। তাঁদের আঁকা পোস্টার গ্যালারি ছিল তখনকার রাজনৈতিক যোগাযোগের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। এই শিল্পই বাঙালির মানস জগতে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল।
১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম চারুকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। খুব দ্রুতই এই বিভাগ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। শিল্পী রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, মিজানুর রহিম এবং তাঁদের সঙ্গে ছাত্র সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, শাহ মোহাম্মদ আনসার আলী, এনায়েত হোসেন, সবিহ উল আলম মিলে লিথোগ্রাফে একটি পোর্টফোলিও তৈরি করেন যা তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এতে ছিল প্রতিবাদ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও জাতিগত জাগরণের বার্তা।
১৯৭১ সালের মার্চ ছিল উত্তাল সময়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী থেকে খুলনা বাংলাদেশের প্রায় সব বড় শহরই তখন বিক্ষোভ, মিছিল আর প্রতিরোধে টালমাটাল। এমন দমন-পীড়ন আর ভয়াবহ রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই ১৭ মার্চ এক বিরল দৃশ্য দেখা যায় ঢাকার রাস্তায়। কবি সুফিয়া কামাল ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ‘ বাংলা চারু ও কারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি মিছিল বের হয় ঢাকা আর্ট কলেজ প্রাঙ্গন থেকে। তাদের হাতে ছিল সাহসী প্লাকার্ড ‘স্বাধীনতা’। এ ছিল শুধু একটি মিছিল নয় এ ছিল দুঃসাহসের এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। কারণ, তখন প্রকাশ্যে ‘স্বাধীনতা’ শব্দ উচ্চারণ করাই ছিল পাকিস্তানি সামরিক শাসনের চোখে রাষ্ট্রদ্রোহ। সেই সময়ে শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবীরা ঢাকার রাস্তায় নেমে এই শব্দকে সামনে তুলে ধরেছিলেন এক ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহ হিসেবেই।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যায় শহীদ হন আর্ট কলেজের কয়েকজন তরুণ শিল্পী–ছাত্র। তাঁদের একজন আর্ট কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র শাহনেওয়াজ ,যার স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে। তাঁদের হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝিয়ে দিয়েছিল, শিল্পকলা ও শিল্পীও তাদের চোখে ছিল রাজনৈতিক ‘হুমকি’;কারণ শিল্পই মানুষের চেতনার জন্ম দেয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মহান মুক্তিযুদ্ধজুড়েই চারুশিল্পীদের সংগঠিত রাখেন। দেশে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অবস্থান করতে না পারলেও তিনি শিল্পীদের মাধ্যমে শরণার্থী সংকট, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টেশন তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করেন। এসব চিত্র আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
প্রবাসী শিল্পীরা তাঁর নির্দেশনা ও উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রদর্শনী আয়োজন করেছিলেন। তিনি অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। অন্যদিকে শিল্পী কামরুল হাসান ছিলেন প্রতিরোধশিল্পের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। ২৫ মার্চের রাতে তিনি নিজ এলাকায় ট্রেঞ্চ খোঁড়ার কাজে নেতৃত্ব দেন। পরে কলকাতায় গিয়ে প্রবাসী সরকারের অধীনে ‘আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগ’ গড়ে তোলেন। চিত্রশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, প্রাণেশ মণ্ডলসহ অনেকে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। কামরুল হাসানের বিখ্যাত পোস্টার ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী ভিজ্যুয়াল অস্ত্র। লক্ষাধিক কপি ছাপিয়ে এটি মুক্তাঞ্চলে বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ৬৬টি চিত্রপ্রদর্শনী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানি নৃশংসতার প্রমাণ তুলে ধরে। যেখানে অংশ নেন কামরুল হাসান, মুস্তাফা মনোয়ার, নিতুন কুন্ডু, দেবদাস চক্রবর্তীসহ ১৭ জন চিত্রশিল্পী।

দেশের বাইরে থেকেও শিল্পীরা মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন। প্যারিসে অবস্থান করে শিল্পী মুর্তজা বশীর পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ছবি আঁকেন যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গণহত্যার বাস্তবতা তুলে ধরতে ভূমিকা রাখে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা আর্ট কলেজের কয়েকজন ছাত্র সশস্ত্র যুদ্ধে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে শাহাবুদ্দিন আহমেদ আজকের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী ;তিনি ছিলেন ২ নং সেক্টরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা- ঢাকার প্লাটুন কমান্ডার। তাঁর শিল্পে আজও ধরা পড়ে যুদ্ধের গতি, শক্তি ও মানবমুক্তির চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্র সংসদ–এর সাধারণ সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন (বাটা সিরাজ নামে পরিচিত) , বরেণ্য চিত্রশিল্পী খাজা কাইয়ূম এবং চিত্রশিল্পী ও শিক্ষাবিদ বনিজুল হক। চিত্রশিল্পী সাইদা কামাল (টুলু) অংশগ্রহন করেছিলেন ২ নং সেক্টরের অধীনে ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে’। তিনি সেখানে একজন সেবিকা হিসেবে কাজ করেন। চিত্রশিল্পী সৈয়দ আবুল বারক আলভী একজন ‘যোদ্ধাশিল্পী’ হিসেবে পরিচিত, যিনি আঁকাআঁকির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে সরাসরি লড়াই করেছেন। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতিত হন। যারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবির এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে একদল নবীন কণ্ঠ শিল্পীদের সাথে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন চিত্রশিল্পী স্বপন চৌধুরী তাদের একজন। সেই চিত্র ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্রে অমর হয়ে আছে। শিল্পী আবদুর রাজ্জাক এবং আবদুল খালেকও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন বলে জানা যায়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, মুক্তাঞ্চলে, ভারতে এবং বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অনেক দৃশ্যশিল্পীই নিজ নিজ অবস্থান থেকে পোস্টার, প্রদর্শনী, চিত্রকর্ম ও প্রচারণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের অবদান প্রকাশ পেলে আরও স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনের লড়াই নয়, এটি শিল্পের রংতুলিতেও রচিত এক জাতীয় সংগ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধ তাই কেবল রণাঙ্গনের জয় নয়; এটি ছিল শিল্প, সংস্কৃতি ও মানবিকতার সম্মিলিত বিজয়। তাঁদের রঙ–তুলি না থাকলে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নের দৃশ্যমান নকশাটি কখনোই এত স্পষ্ট হতো না।
মহান বিজয়ের এই ডিসেম্বর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা শুধু রণাঙ্গনের রক্তে রঞ্জিত নয়; এর প্রতিটি রং, প্রতিটি রেখায় লুকিয়ে আছে চারুশিল্পীদের অন্তর্দীপ্ত সৃজনশীলতা, সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ এবং জাতির প্রতি অপরিসীম দায়বদ্ধতা। যারা তুলি দিয়ে সংগ্রাম করেছেন, রং দিয়ে উচ্চারণ করেছেন স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞা, পোস্টার ও কার্টুন এঁকে জনগণকে সংগঠিত করেছেন তাঁদের অবদান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরদিন অমর হয়ে থাকবে।
এই দেশপ্রেম, এই শিল্পযুদ্ধের সর্বোচ্চ প্রতীক হয়ে আছে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার নকশা; যার লাল সূর্যের বুকে হলুদ রঙে অঙ্কিত বাংলাদেশ মানচিত্র এঁকেছিলেন চারুশিল্পী শিব নারায়ণ দাশ। তাঁর হাতে উঠে আসা সেই মানচিত্র ছিল কেবল এক নকশা নয়; ছিল লক্ষ কোটি বাঙালির স্বপ্নের দৃশ্যমান রূপ, ছিল আমাদের অস্তিত্বের ঘোষণা। সেই পতাকার নিচে দাঁড়িয়েই বাঙালি জন্ম দিয়েছে একটি মুক্ত দেশের, একটি নতুন ইতিহাসের। আজ বিজয়ের মাসে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি শিব নারায়ণ দাশকে এবং সেই সব শিল্পীদের যাঁদের কারও নাম বইয়ে নেই, কারও আঁকা পোস্টার হারিয়ে গেছে সময়ের ভাঁজে, কিন্তু যাঁদের হাতের শক্তি ও হৃদয়ের উত্তাপেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠেছিল দৃশ্যমান, উচ্চারণযোগ্য এবং অবিনাশী। তাঁরা আমাদের জাতির নান্দনিক যোদ্ধা, তাঁরা চেতনার স্থপতি।
বাংলাদেশের আকাশে আজ যখন পতাকা উড়ে, আমরা যেন মনে রাখি-এই পতাকার রং শুধু যুদ্ধের বিজয় নয়, শিল্পেরও বিজয়; এটি বাঙালির সেই শিল্পী–আত্মার জয়, যারা রংতুলি দিয়ে ইতিহাসকে আলোকিত করেছিলেন। তাঁদের প্রতি আমাদের চিরকৃতজ্ঞতা, চিরসম্মান। জয় বাংলা।