সর্বশেষ

মতামত

অন্ধকারের ঠকঠকঃ বুদ্ধিজীবী হত্যার পুনরাবৃত্তি

প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩:৫২
অন্ধকারের ঠকঠকঃ বুদ্ধিজীবী হত্যার পুনরাবৃত্তি

১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। রাতের গভীরতা তখন ইতিহাসের সবচেয়ে ঘন অন্ধকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলঘর, কলাবাগানের বাসা, মোহাম্মদপুরের বারান্দা—সবখানে এক অদ্ভুত শব্দ। ঠক ঠক। দরজায়। ভেতর থেকে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর, “কে?” বাইরের সুশীল শীতল কণ্ঠস্বর, মুখ ঢাকা, ছায়ার মতো, বলিল—“স্যার, একটু কথা ছিল। বাইরে আসেন।”


স্যার বাইরে গিয়াছেন। আর ফিরেন নাই। তাঁহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে রায়েরবাজারে, মিরপুরে, বধ্যভূমির ধূলায়। তাঁহার কলম থেমে গিয়াছে। তাঁহার কণ্ঠ স্তব্ধ। তাঁহার চিন্তা আজও রক্তাক্ত।


সেই যে অন্ধকারে মিশিয়া যাওয়া কণ্ঠ, সেই যে মুখ ঢাকা সালাম-দাতা, সে কি হারাইয়াছে? না, সে তো আজও আছে। সে আজও দরজায় আসে। সে আজও বলে—“ভাই, একটু কথা ছিল।” সে আজও বলে—“আপনি তো দেশপ্রেমিক, আসেন একটু বাইরে।” সে আজও বলে—“আপনার ছেলেটিকে মাদ্রাসায় দেন, ইসলামী আদর্শে মানুষ হইবে।” সে আজও বলে—“সংস্কৃতি তো হারাম, গান বাজনা তো বেদাত।”


সে আজ জামায়াত। সে আজ শিবির। সে আজ ইসলামী মৌলবাদ। সে আজ সরকারের বাহবায় পুষ্ট, পৃষ্ঠপোষকতায় বলীয়ান।


সে আজ মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেয়, সে আজ টকশোতে বসে যুক্তি দেয়, সে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে ঢুকে প্রশ্ন করে—“মুক্তিযুদ্ধ কি ইসলামী ছিল?” সে আজ বলে—“১৪ ডিসেম্বর তো অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।”


সে আজ শিল্পকে বলে অশ্লীল, সাহিত্যকে বলে বিভ্রান্তিকর, সংস্কৃতিকে বলে অপসংস্কৃতি।


সে আজ বাঙালির আবহমান ঐতিহ্যকে কুপিয়ে কাটে, সে আজ রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়, সে আজ নজরুলকে মৌলবাদে রূপান্তর করে।
সে আজও দরজায় আসে। সে আজও ঠক ঠক করে। সে আজও বলে—“স্যার, একটু কথা ছিল।”


কিন্তু আজকের স্যার কি বুঝেন? আজকের স্যার কি চিনেন সেই কণ্ঠ? আজকের স্যার কি বলেন—“আমি বাইরে যাব না”? না, আজকের স্যার বলেন—“আসছি ভাই, একটু দেখি কী বলেন।”


অন্ধকারের সেই কণ্ঠ আজও শক্তিশালী। কারণ, সে আজ সরকারের বন্ধু। সে আজ ভোটের হিসাব। সে আজ জোটের শরিক। সে আজ মন্ত্রীর আত্মীয়। সে আজ রাষ্ট্রের ছায়া।


তাহার পেছনে আজও রক্ত আছে। তাহার পেছনে আজও বধ্যভূমি আছে। তাহার পেছনে আজও ১৪ ডিসেম্বরের কান্না আছে।


তবু আমরা বলি—“আসেন ভাই, একটু কথা হোক।” তবু আমরা বলি—“ধর্ম তো ভালো জিনিস।” তবু আমরা বলি—“রাজনীতি তো সমঝোতার জায়গা।”
তবু আমরা ভুলে যাই, যে দরজায় ঠক ঠক করে, সে কেবল কথা বলতে চায় না— সে চায় ইতিহাস মুছে ফেলতে।


এ অন্ধকার কবে শেষ হইবে? কবে মিলিবে আলোর সন্ধান? কবে আমরা বলিব—“না, আর নয়”? কবে আমরা বলিব—“আমার দরজা বন্ধ”? কবে আমরা বলিব—“আমার চিন্তা, আমার সংস্কৃতি, আমার বাংলাদেশ—অন্ধকারের কাছে বিক্রি নয়”?


হয়তো সেই দিন আসিবে, যখন ঠক ঠক শব্দে আমরা আর ভয় পাব না, বরং বলিব—“তুমি কে? মুখ দেখাও। ইতিহাসের সামনে দাঁড়াও।”

 

লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল - অন্ধকার সময়গুলোকে যে দীপাবলি জ্বালিয়ে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে আলোকিত দিনের প্রত্যাশায়

সব খবর