সর্বশেষ

মতামত

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিনষ্ট, রাষ্ট্রের নীরব অবহেলা

প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিনষ্ট, রাষ্ট্রের নীরব অবহেলা

মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স—যেখানে একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ হয়েছিল, যেখানে উচ্চারিত হয়েছিল রাষ্ট্র গঠনের প্রথম অমর শপথ—আজ সেই পবিত্র ভূমি পড়ে আছে ভাঙচুরের চিহ্নে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেখানে কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেই। ভাঙা ভাস্কর্যের টুকরো, ধুলোমাখা অবহেলা আর নীরবতা, এটাই আজকের রাষ্ট্রীয় “স্মৃতি।”

 

মুজিবনগর একা নয়। গাজীপুরের ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’ মুক্তমঞ্চ, মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট স্মৃতিসৌধ—সবখানেই একই চিত্র। কোথাও ভাঙা দেয়াল, কোথাও উপড়ে ফেলা ভাস্কর্য, কোথাও অগ্নিদগ্ধ স্মৃতিচিহ্ন। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো—এক বছর পেরিয়েও কোনো দিক থেকে দৃশ্যমান সংস্কারের কাজ শুরু হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, অন্তত ৩৫ জেলা থেকে মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর এসেছে। এর বাইরে জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমিসহ আরও ৩৩টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু এসব তথ্য কেবল কাগজে—মাঠে কিছুই হয়নি।

 

২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় দেশের প্রায় ৫৯ জেলায় ১,৫০০-এর বেশি ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়। এর অধিকাংশই বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের স্মৃতিচিহ্ন। এটি শুধু স্থাপনার ওপর আঘাত ছিল না—এটি ইতিহাস, চেতনা ও জাতির আত্মপরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত।

 

কিন্তু এক বছর পেরিয়েও রাষ্ট্র কেন নীরব? সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো একে অন্যের দিকে দায় চাপাচ্ছে—কোথাও বাজেট নেই, কোথাও নকশা অনুমোদনের অজুহাত, কোথাও ‘পরবর্তী নির্দেশনার’ অপেক্ষা। এই প্রশাসনিক জটিলতার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে জাতির ইতিহাস।

 

ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনা শুধুই ইট-পাথর নয়—এগুলো জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ। এগুলো ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভুল বার্তা যাবে—যে রাষ্ট্র তার ইতিহাস রক্ষা করতে ব্যর্থ। একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাষায়, “যে জাতি তার যুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে পারে না, সে জাতি তার স্বাধীনতাকেও টিকিয়ে রাখতে পারে না।”

 

এই অবহেলা শুধু ইতিহাসকে নয়—এটি জাতিকে নষ্ট করার একটি পরিকল্পিত সংস্কৃতি সৃষ্টি করছে। আজ যদি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা থাকে, কাল হয়তো বধ্যভূমির চিহ্নও হারিয়ে যাবে। তখন প্রশ্ন করার মতো কেউ থাকবে কি?

 

রাষ্ট্রকে এখন কেবল নিন্দা নয়, বরং জরুরি ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সময়নিষ্ঠ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় জনগণ, মুক্তিযোদ্ধা ও ইতিহাসবিদদের সম্পৃক্ত করে এই স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

মুক্তিযুদ্ধ কোনো অতীত নয়—এটি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভিত্তি। সেই ভিত্তি যদি ভাঙা পড়ে থাকে, রাষ্ট্রও দুর্বল হয়ে যাবে। মুজিবনগর থেকে গাজীপুর, মাদারীপুর থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল—সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকা এই ভাঙচুরের চিহ্ন আমাদের একটাই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়: আমরা কি শুধু দিবসের আলোয় মুক্তিযুদ্ধ স্মরণ করব, নাকি তার স্মৃতিকে সত্যিই রক্ষা করব?

 

এভাবে রাষ্ট্রের উদাসীনতা বরং জাতির বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে—যা স্বাধীনতার চেতনায় এক ভয়ঙ্কর ছেঁড়া সৃষ্টি করছে।

সব খবর

আরও পড়ুন

নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ মিশনে সর্বপ্রথম বিজয় দিবস পালন

স্মৃতিকথা নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ মিশনে সর্বপ্রথম বিজয় দিবস পালন

নয়া বন্দোবস্তের বাংলাদেশে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে জামাতময় বিজয় উৎসব

মতামত নয়া বন্দোবস্তের বাংলাদেশে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে জামাতময় বিজয় উৎসব

যে ইতিহাস শিক্ষক জানতেন পাকিস্তান টিকবে না

বুদ্ধিজীবী দিবসে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি যে ইতিহাস শিক্ষক জানতেন পাকিস্তান টিকবে না

ডিসেম্বরের কাছে ফিরে যাওয়া: তরুণদের বাংলাদেশ ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন

মতামত ডিসেম্বরের কাছে ফিরে যাওয়া: তরুণদের বাংলাদেশ ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন

হাত-পা বাঁধা লাশ, অশ্রুসিক্ত বিজয়—জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস : বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি হাত-পা বাঁধা লাশ, অশ্রুসিক্ত বিজয়—জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা

শিল্পীর রেখায় মুক্তির স্বপ্ন

রঙতুলির বিদ্রোহ শিল্পীর রেখায় মুক্তির স্বপ্ন

নিখোঁজ এস এম কামরুজ্জামান সাগরকে ঘিরে উদ্ভূত উদ্বেগ ও জাতির দায়বদ্ধতা

মানবাধিকার সংকটের নতুন আতঙ্ক নিখোঁজ এস এম কামরুজ্জামান সাগরকে ঘিরে উদ্ভূত উদ্বেগ ও জাতির দায়বদ্ধতা

মুক্তিযুদ্ধের নয়া বয়ান: জামায়াতের সহীহ ইতিহাস

ব্যঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের নয়া বয়ান: জামায়াতের সহীহ ইতিহাস