সর্বশেষ

মতামত

বাংলাদেশের খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ: বিনিয়োগের আড়ালে ভূরাজনৈতিক খেলা

প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৮
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ: বিনিয়োগের আড়ালে ভূরাজনৈতিক খেলা
বিডি ভয়েস গ্রাফিক্স

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলেছে। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশের গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের সব ক্রয় প্রক্রিয়া হোক ‘উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ’। কিন্তু এই বক্তব্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরেকটি বাস্তবতা—বাংলাদেশের খনিজ সম্পদে বহুদিনের মার্কিন কৌশলগত আগ্রহ।

 

যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহ

 

আজকে নতুন করে নয়, বহু বছর ধরেই মার্কিন জ্বালানি জায়ান্টরা বাংলাদেশের গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানে চোখ রাখছে। শেভরন এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালনা করছে একটি এলএনজি টার্মিনাল।

 

২০২৩ সালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস ঢাকায় তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানেই এক্সন মোবিলসহ বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আগ্রহ স্পষ্ট হয়। পরে সেসময় গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় বাংলাদেশে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে প্রস্তুত এক্সন মোবিল। এমনকি এ নিয়ে প্রতিমন্ত্রীকে লিখিত প্রস্তাবও দেয় তারা।

 

পরে ইউএস–বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে একযোগে জানায়, গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানে তারা আগ্রহী।

 

বিনিয়োগ হয়নি কেন?

 

প্রশ্ন হলো, এত আশাব্যঞ্জক আলোচনা সত্ত্বেও বিনিয়োগ কেন বাস্তবায়িত হলো না? উত্তরটা সরল নয়।

 

এক্সন মোবিল তখন শর্ত দিয়েছিল—বাংলাদেশের অনশোর ও অফশোর মিলিয়ে ২৪টি ব্লকের একক নিয়ন্ত্রণ তারা চায়, যা দিতে হবে আনসলিসিটেডভাবে, অর্থাৎ কোনো আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়াই বিশেষ আইনের মাধ্যমে। সহজ ভাষায়, প্রতিযোগিতা এড়িয়ে বিশেষ সুবিধা।

 

এর অর্থ দাঁড়াত, বঙ্গোপসাগরের বিশাল সমুদ্রসীমা কার্যত মার্কিন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থরক্ষা করতে সেখানে মার্কিন রণতরীও মোতায়েন করতে পারত। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে কোয়াডে টেনে আনার ব্যর্থতার পর, এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশল।

 

কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিজনক এই দাবি সরাসরি নাকচ করে। বরং ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অফশোর বিডিং রাউন্ড ঘোষণা করে। নীতি ছিল পরিষ্কার—আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই কাজ পাবে যোগ্য প্রতিষ্ঠান।

 

সরকার পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি

 

২০২৪ সালের ৫ আগটে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। টেন্ডার কিনে রাখা সাতটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি আগ্রহ হারায়। এদিকে হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে “স্বচ্ছতা”র বুলি শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—স্বচ্ছতার আড়ালে কি আসলে নতুন করে আনসলিসিটেড চুক্তির পথ তৈরি করা হচ্ছে?

 

ভূরাজনীতির ছায়া

 

এখানে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের চেয়েও বড় বিষয় হলো ভূরাজনীতি। এক্সন মোবিলের মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান যদি বাংলাদেশে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তবে তা শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতা হবে না—এর সঙ্গে আসবে মার্কিন কৌশলগত উপস্থিতি। আর সেটি মানেই বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী স্বার্থ, সামরিক তৎপরতা এবং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে নতুন খেলা।

 

বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ নিছক অর্থনৈতিক সম্পদ নয়—এটি আমাদের সার্বভৌমত্ব ও ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্ন। আমাদের বিনিয়োগ দরকার, কিন্তু বিনিময়ে সমুদ্রসীমা ও সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা বিদেশি স্বার্থে সমর্পণ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সব খবর