গত বর্ষে এক আন্দোলনকারী, পুলিশের বুটের আঘাতে জমিনে পড়িতে দেখিয়া জনৈক সুশীল উচ্চারণ করিয়াছিলেন—“খোদার আরশ কাঁপিতেছে! আসমান কাঁপিতেছে!” সে এক মহাকাব্যিক দৃশ্য। চারিদিকে টিয়ার গ্যাস, লাঠির ঝাঁজ আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক নারী, যাঁহার কণ্ঠে ঈশ্বরের সিংহাসনও নড়িয়া উঠিল। তখন মনে হইল, বুঝি এবার সত্যই আসমান ভেঙে পড়িবে, আরশ ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িবে রাস্তায় আর পুলিশ ভাইয়েরা তাহা কাঁধে লইয়া থানায় লইয়া যাইবেন।
কিন্তু হায়! এক বছর পেরাইয়া গেল, আসমান এখনো কাঁপে না বরং হেলিয়া পড়িয়াছে। আরশ কাঁপিতে কাঁপিতে ক্লান্ত, এখন টলিয়া পড়িবার অপেক্ষায়। আন্দোলনকারী সেই বীর কোথায়? তিনি এখন হয়তো ফেসবুকে “আলহামদুলিল্লাহ” লিখিয়া কাঁচা মরিচের দাম ৩০০ টাকা হইবার সংবাদে ঈশ্বরের রহমত খুঁজিতেছেন।
এদিকে জমিনে কাঁপাকাঁপি চলিতেছে। মুক্তিযোদ্ধার টুঁটি চেপে ধরিবার জন্য এখন মব প্রস্তুত থাকে, যেন টুঁটি চেপে ধরাই জাতীয় খেলা। ঘরবাড়ি লুটপাট এখন উৎসবের অংশ আর পুলিশ ভাইয়েরা ছাত্রদের দিকে টিয়ার ছোঁড়েন, যেন তাহা নবীন বর্ষার আগমন। বুটের পাড়ায় মাথা চেপে ধরিবার কৌশল এখন পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হইবার অপেক্ষায়।
আকাশে মৃদু কম্পন লাগে, কিন্তু তাহা কি সত্যিই আরশে পৌঁছায়? নাকি মাঝপথে থামিয়া যায়? ঈশ্বরও এখন সরকারি বিজ্ঞপ্তি না পাইলে নড়েন না! লওহে মাহফুজ থেকে ফুল ঝরে কিন্তু বাজারে সবজির দাম শুনিয়া সেই ফুলও শুকাইয়া যায়। পথে ঘাটে যখন নারী হেনস্তা হয়, 'কানকে মাগে ওড়না কই' আর টিনের চালে কাউয়ার সাথে শারীরিক প্রত্যঙ্গের অন্তরঙ্গতা, তখন আরশে মোকামে নাশিদের মূর্ছনা ছোটে—যেন ঈশ্বরের Spotify প্লেলিস্টে এখন শুধু “সাবর করো যারা”।
আন্দোলনকারীদের সেই আহাজারি- যাহা একদিন বাতাস কাঁপাইত, এখন হাওয়ার সঙ্গে মিলাইয়া গিয়াছে। বাতাসও ক্লান্ত—সে আর কাঁপে না, শুধু ধুলা উড়ায়। এখন কাঁপাকাঁপি হয় জমিনে, আম জনতার বুকে। বাজারে গেলে হৃদস্পন্দন বাড়ে, পকেট ফাঁকা হইয়া যায় আর মন বলে—“আসমান কাঁপুক, আমার তো চাল কিনিবার টাকাও নাই।”
তবু আশাবাদী হই। হয়তো একদিন আবার কেউ বলিবে—“আসমান কাঁপিতেছে!” তবে সে কণ্ঠে থাকিবে না প্রতিবাদ, থাকিবে একখানা TikTok ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। আরশ তখন হয়তো বলিবে—“ভাই, একটু শান্তি দাও, আমিও তো সরকারি কর্মচারী!”
লেখকঃ যে তাহার ধ্বংসের সময়টাকে চেতনার কালিতে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে।