যুগের হাওয়া বদলাইয়াছে, কালের গতি ঘুরিয়াছে আর সেই ঘূর্ণনের মাঝেই সরকার বাহাদুর এক মহাজাগতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন—অমর একুশে বইমেলা হইবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হইতে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত। হায়! কী অপূর্ব, কী দূরদর্শীতা, কী যুগান্তকারী ভাবনা! এমন সিদ্ধান্তে ইতিহাসের পাতাও শারদীয় হাওয়ায় ভাসিয়া উড়িতে উড়িতে নালায় পড়িতেছে।
বইমেলা তো কেবল বই কেনা-বেচার স্থান নহে, ইহা এক জাতীয় আবেগ, এক সাংস্কৃতিক মহাযজ্ঞ। অতএব, ইহা যদি ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তাহার মাহাত্ম্য বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। স্কুল-কলেজ বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা, যানজটের বালাই নাই। সপরিবারে বইমেলায় যাইবার সুবিধা, পেছনে পিঠা, সামনে পেঁয়াজু আর হাতে এক কাপ চা—এই দৃশ্য তো কবিতার উপাদান হইতে পারে।
শীতের মৃদু পরশে বইমেলার মাঠে হাঁটিয়া বেড়াইবার যে সুখ, তাহা গ্রীষ্মের ঘামে ভেজা কপালে কল্পনাও করা যায় না। বই প্রকাশকগণ যেমন খুশি, তেমনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাগণও ব্যবসায়িক সফলতায় নাচিয়া ওঠেন। সিঙ্গারা বিক্রেতা, চা-ওয়ালা, বাচ্চাদের বেলুন বিক্রেতা—সবাই যেন এক উৎসবের রঙে রাঙা।
এতসব সুবিধা বিবেচনা করিয়া সরকার বাহাদুর যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন, তাহা নিঃসন্দেহে নোবেল পুরস্কার-এর যোগ্য। এমনকি ইউনেস্কো যদি ‘উৎসব পরিকল্পনা’ বিভাগ খুলে, তবে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাহার প্রথম পুরস্কার পাইবে।
তবে, ব্যাঙের ছাতার মত কিছু নিন্দুক মাথা তুলিয়াছে। তাহারা বলিতেছে, “বইমেলা তো ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত, ফেব্রুয়ারির মাহাত্ম্য আছে।” হায়! এ কী অজ্ঞতা! উৎসব তো জনগণকে কেন্দ্র করিয়া হয়। আর জনগণের কিসে ভালো, তাহা সরকার বাহাদুরই ভালো জানেন। অতএব, ফেব্রুয়ারি হইতে ডিসেম্বর—ইহা এক প্রয়োজনীয় রূপান্তর।
এইক্ষেত্রে আমরা আরও এক ধাপ আগাইতে পারি। ১৪ ফেব্রুয়ারির বসন্ত উৎসব, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস, ঈদুল ফিতর, শবে কদর—সবই যদি ডিসেম্বর মাসে স্থানান্তরিত হয়, তবে জনগণের দূর্দশা লাঘব হইবে। এক মাসেই সব আনন্দ, সব ছুটি, সব উৎসব—বাকি মাসগুলি কর্মে নিবিষ্ট থাকিবার সুযোগ। অর্থনীতি চাঙ্গা, মনোবল দৃঢ় আর জাতীয় পরিকল্পনা এক সুসংহত রূপ পাইবে।
আইন উপদেষ্টা বলিয়াছেন, “ইতিহাসে এমন কাজ আর কখনো হয় নাই এবং ভবিষ্যতেও না।” আমরা তাহার প্রত্যয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। এমন সিদ্ধান্তে জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি পায়, আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জিত হয়। জাতিসংঘের সভায় যদি এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়, তবে অন্যান্য দেশও আমাদের পথ অনুসরণ করিবে।
তবে, যাহারা এই সিদ্ধান্তকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করিবে, তাহাদের দাঁড়ি ধরিয়া কাড়াকাড়ি না করিয়া, দাঁড়িপাল্লায় তুলিয়া বিচার করা হইবে। কারণ, সরকার বাহাদুর এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খেলোয়াড়। তাহাদের সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তোলা মানে জাতির সম্মান ক্ষুণ্ণ করা।
সুতরাং, আসুন আমরা সকলে মিলিয়া এই মহান সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই। ডিসেম্বর হোক উৎসবের মাস, বইমেলা হোক পেঁয়াজু-সিঙ্গারার সুবাসে ভাসমান এক আনন্দলোক আর ইতিহাস হোক পুনর্লিখিত—সরকার বাহাদুরের কলমে, জনগণের কল্যাণে।
লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল; যে তাহার অন্ধকার দিনের আত্মজীবনি গ্লানির কালিতে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতেছে