সর্বশেষ

মতামত

নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় হচ্ছে না নির্বাচন

প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:৫৬
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় হচ্ছে না নির্বাচন

সম্প্রতি এক উপদেষ্টার মন্তব্য ও তার প্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে ব্যাখ্যা দেওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে পুরোনো প্রশ্নটি ফিরে এসেছে যে, নির্বাচন কে দেবে, আর কতটা নিরপেক্ষ হবে সেই আয়োজন?


অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন বলছে, নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর না করা পর্যন্ত তারাই ক্ষমতায় থাকবে এবং উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকও নিয়মিত চলবে। অর্থাৎ, এই সরকারের হাতেই নির্বাচনের প্রস্তুতি, পরিচালনা ও ফলাফল ঘোষণার পুরো প্রক্রিয়া। কিন্তু এই ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সামনে এসেছে আরেকটি প্রশ্ন, এই সরকার কি সত্যিই নিরপেক্ষ?

 

“অন্তর্বর্তী” না “তত্ত্বাবধায়ক”?

 

বাংলাদেশে “তত্ত্বাবধায়ক সরকার” মানে একসময় বোঝাত একটি অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ প্রশাসন, যা নির্বাচনের আগে ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ তৈরি করে। সেই ব্যবস্থাটি ২০১১ সালে বাতিল হয়। এরপর থেকে প্রতিটি নির্বাচনের আগেই প্রশ্ন ওঠে, ক্ষমতাসীন কোনো সরকারের অধীনে কি নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব?

 

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, তারা সংস্কার কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং নির্বাচনের আগেও সেই কাজ চলবে। কিন্তু বিএনপির মতে, এই সরকারেরই এখন “কেয়ারটেকার” সরকারের মতো নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া উচিত, কারণ আর কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসছে না। তাদের দাবি, প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে নির্বাচনের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে নির্বাচনের ব্যাপারে অবশ্য বিএনপির কোনো আপত্তি দৃশ্যমান নয়। তাহলে কি ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায় বিএনপি? তাহলে তাদের নিরপেক্ষতার দাবী কি আদতে তাদের পক্ষে থাকার দাবী?

 

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, এই সরকার নিরপেক্ষ নয়, বরং তাদের সীমাহীন দমন-পীড়ন করছে গত ১৪ মাস ধরে। দলটির অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে, সারাদেশে নেতা-কর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলা দিয়েছে, আটক করেছে অন্তত ৫০ হাজার নেতা-কর্মীকে, এবং “ক্যাঙ্গারু ট্রায়াল” এর মাধ্যমে দলের সিনিয়র নেতাদের ফাঁসির প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের মতে, দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে কোনোভাবেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়।

 

দুই পক্ষ, এক অনাস্থা

 

বিএনপি বলছে, সরকার এখনো নিরপেক্ষ নয়; আওয়ামী লীগ বলছে, সরকার ইতিমধ্যে পক্ষপাতদুষ্ট। শুনতে বিপরীতমুখী মনে হলেও, আসলে দুই পক্ষই এক কথাই বলছে যে এই সরকার নিরপেক্ষ নয়। অর্থাৎ, উভয় দিক থেকেই ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার ওপর অনাস্থা প্রকাশিত হচ্ছে।

 

এই অবস্থায় নির্বাচন যতই সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে হোক, রাজনৈতিক আস্থা ছাড়া তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হলো জনগণ ও রাজনৈতিক দলের আস্থা। যেখানে সেটাই অনুপস্থিত, সেখানে নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই।

 

নির্বাচন ও নিরপেক্ষতার বাস্তব সংকট

 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো একটি অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু সরকারের কর্মকাণ্ডে যে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে, তা সেই লক্ষ্যের ঠিক বিপরীতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ মাঠের বাইরে, বিএনপি বলছে প্রশাসন এখনো নিরপেক্ষ নয়। এই দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত।

 

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার ও ফাঁসির তোড়জোড়ও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলও প্রশ্ন তুলছে যে এই বিচার কি ন্যায়বিচারের উদাহরণ, নাকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা? যদি বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, তবে সেটি গণতন্ত্র নয়, বরং একপক্ষীয় কর্তৃত্বের ইঙ্গিত দেয়।

 

সরকার অবশ্য বলছে, তারা দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও মানবাধিকার রক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো যখন একটি বড় রাজনৈতিক দল কার্যত নিষিদ্ধ বা দমনপীড়নের মুখে, তখন কোনো সংস্কারই নিরপেক্ষতার প্রতীক হতে পারে না।

 

প্রশাসন ও আস্থার প্রশ্ন

 

নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হলো প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা কাঠামোর স্বাধীনতা। কিন্তু এই তিন ক্ষেত্রেই অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা তাদের অংশীজনদের নগ্ন হস্তক্ষেপের একাধিক প্রমাণিত উদাহরণ রয়েছে। নাগরিক সমাজ মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকার তার স্বচ্ছতা ও নৈতিক অবস্থান ইতোমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছে।

 

এখন সরকারের সামনে দুটি বড় কাজ—
১. সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা,
২. প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা।


এগুলোর একটিও যদি বাস্তবায়িত না হয়, তবে নির্বাচন যত ভালোভাবেই অনুষ্ঠিত করার দাবী অন্তর্বর্তী সরকার করুক না কেন, সেটি বাস্তবে দূরে থাক কাগজে-কলমেও গ্রহণযোগ্য বলা যাবে না।

 

আস্থাই এখন মূল চাবিকাঠি

 

সরকার বলছে, তারা নভেম্বরের পরও সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাবে এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর না করা পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবে। কিন্তু জনগণ জানতে চায়, এই সরকার আসলে কার স্বার্থে কাজ করছে?

 

গণতন্ত্রে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন কেবল ভোটের আয়োজন নয়; আস্থা প্রতিষ্ঠা করাও। যদি ভোটাররা মনে করেন সরকার আগেই পক্ষ ঠিক করে ফেলেছে, তবে নির্বাচনের ফল যাই হোক না কেন, সেটি গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।

 

বাংলাদেশ আজ এক রাজনৈতিক ‘ডেডলকে’। বিএনপি চায় এই সরকার তত্ত্বাবধায়ক চরিত্র ধারণ করুক; আওয়ামী লীগ বলছে, সরকার তাদের ধ্বংস করতে চাইছে; আর সরকার নিজে বলছে সব চলছে নিয়মমাফিক। ইতোমধ্যেই নিরপেক্ষতা হারানো সরকার কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক চরিতে ধারণ করবে? বিএনপি কি এই ফাঁকিটুকু বুঝতে অক্ষম নাকি সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দল হওয়ার স্বপ্নে এতোটাই বিভোর যে এটাকে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না?

 

বাস্তবতা হলো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নয়, বরং পক্ষপাত আর অবিশ্বাসের মাঝেই এই নির্বাচন এগোচ্ছে। যে নির্বাচনে একটি প্রধান দল কার্যত বাইরে সেই নির্বাচন গণতন্ত্র নয়, বরং প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

 

অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখন একটাই পরীক্ষা, তারা কি সত্যিই নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে পারবে, নাকি ইতিহাস লিখবে এক নতুন অধ্যায়:
“নির্বাচনের ছলে আস্থাহীনতা ও দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে হত্যার সময়কাল।”

সব খবর

আরও পড়ুন

রাজনীতির সার্কাসে সোনার বাংলায় নামিতেছে শীত, আতঙ্কের জনপদ

ব্যঙ্গ কলাম রাজনীতির সার্কাসে সোনার বাংলায় নামিতেছে শীত, আতঙ্কের জনপদ

রয়টার্সের প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ, বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে হুমকি—বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীনতা নতুন সংকটে

মতামত রয়টার্সের প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ, বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে হুমকি—বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীনতা নতুন সংকটে

দূষিত পানি খেয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা

চট্টগ্রাম কারাগারে ভয়ংকর মানবিক সংকট দূষিত পানি খেয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা

শেখ হাসিনার নীরব প্রত্যাবর্তন

রহমান বাঙ্গালি’র মতামত কলাম শেখ হাসিনার নীরব প্রত্যাবর্তন

নারীপ্রেমে উন্মত্ত জামায়াত: তিন শূন্যের মহাপরিকল্পনা

ব্যঙ্গ কলাম নারীপ্রেমে উন্মত্ত জামায়াত: তিন শূন্যের মহাপরিকল্পনা

শান্তির দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি কেন?

মতামত শান্তির দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি কেন?

পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলে নিরাপত্তা ঝুঁকি, সতর্ক নজরদারি জরুরি

মতামত পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলে নিরাপত্তা ঝুঁকি, সতর্ক নজরদারি জরুরি

আর্মচেয়ার প্রবৃত্তির আর্মচেয়ার নেশন: ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনোকালে?

মতামত আর্মচেয়ার প্রবৃত্তির আর্মচেয়ার নেশন: ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনোকালে?