১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস। এই দিন আসলেই আমার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী বড়ভাই অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদের কথা মনে পড়ে। তিনি ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন । ১৯৭১ সালে মহসিন হলের হাউস টিউটার ছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে ১৪ই ডিসেম্বরে আলবদর, আল শামস বাহিনী তাকে চোখ বেধে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
গিয়াস ভাই সুপুরুষ ছিলেন। তিনি তখনো বিয়ে করেন নি। তার গলার আওয়াজ ছিল অত্যন্ত ভারী। তিনি আমার আরেক বড়ভাই এ এম এ মুহিতের বন্ধু ছিলেন। তবে বিভিন্ন কারণে তিনি আমাদের পরিবারের একজন একান্ত ঘনিষ্ঠ জন হয়ে উঠেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ডিসেন্ট্রি ও কলেরা রোগ ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী, ডাঃ নুরুল হোসেন চঞ্চল, ডাঃ হারিস আলী, আওয়ামী লীগ নেতা ইসমত চৌধুরী প্রমুখ আমাকে কিছু ঔষধ সংগ্রহ করে পাঠাতে বললেন। তৎকালীন সময়ে আমার এক বড়ভাই শেলী মুবদি একটি বড় বিদেশী ঔষধ (ICI) কোম্পানির সেলস ম্যনেজার ছিলেন (বর্তমানে নিউ ইয়র্কে থাকেন) এবং তার অনেক বন্ধু বান্ধব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে কাজ করতেন। ওদেরে আমি চিনতাম। তাছাড়া আমার বড়বোন একজন ডাক্তার ছিলেন । তাই তারা আমাকে কিছু ঔষধ জোগাড় করতে বলেন।
ঢাকায় ফিরে এসে জানলাম যে, মুবদি ভাই অপারেশন সার্চলাইটের হত্যাযজ্ঞের পর পরই লণ্ডনে চলে গেছেন । সুতরাং আইসিআই-এর ঔষুধ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আমার ক্লাসফ্রেন্ড আশফাকুর রহমানের (পরবর্তীতে সে রাষ্ট্রদূত হয়) বড়ভাই হাফিজ সাহেব তখনো আইসিআই -এ কর্মরত ছিলেন। এদিকে ওয়েথ লেবের সেলস ম্যানেজার ছিলেন জেনারেল ওসমানীর চাচাত ভাই মুসলেহ ঊর রহমান ওসমানী। আমার আরেক ক্লাসফ্রেন্ড আজমলের (সিলেটের শেখঘাটে ওদের বাসা ছিল) বড়ভাই যিনি আরেকটি বিদেশী ঔষধ কোম্পানিতে কাজ করতেন (এখন তার নাম মনে আসছে না) ছাড়াও আমার বড়বোন ডাঃ শাহলা খাতুন এবং তার অনেক সহকর্মী আমাকে বিভিন্ন ধরণের ঔষধ দিতেন। প্রতি মাসেই বিভিন্ন জনের কাছ থেকে যথেষ্ঠ ঔষধ সংগ্রহ হতো। তখন আমার আরো দুজন সহপাঠি ঔষধ কোম্পানির সেলসম্যান ছিল। তারাও সময সময় সাহায্য করতো।
আমি শাহলা আপার মরিস মাইনর গাড়িতে করে ঔষধগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে গিয়াস ভাইকে দিতাম। কাজটি লুকিয়ে লুকিয়ে করতে হতো । গিয়াস ভাই ঐ ঔষধগুলো মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। সেজন্য হয়তো আল বদর ও আল শামস বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
একদিনের অত্যন্ত স্মরণীয় এক কাহিনী না বললে নয়। একদিন আমি ও গিয়াস ভাই বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক ঔষধ জোগাড় করি। গাড়ি ভর্তি ঔষধ। গাড়ির ডাব্বা ছাড়াও গাড়ির সিটের মধ্যে বাক্স বাক্স ঔষধ। আমি গাড়ি চালাচ্ছি এবং গিয়াস ভাই পাশে বসে আছেন। ধানমণ্ডির ৫নং রোডের কাছে মিরপুর রোডে পাক হানাদার বাহিনী আমার গাড়িটি থামাতে বললে গাড়ি থামাই। তারা গাড়িতে এতসব ঔষধ দেখে বার বার প্রশ্ন করতে থাকে। গাড়ির পেছনের গ্লাসে “রেডক্রসের” এমব্লেম ছিলো। সামনের গ্লাসে সার্জন এর ইনসিগনিয়া থাকায় তাদের বুঝাতে সক্ষম হই যে এটা ডাক্তারের গাড়ি, আর ঔষধগুলো ডাক্তারের। তখন তারা ছেড়ে দেয়। গিয়াস ভাই যিনি সব সময় অকুতোভয়, সেদিন কিন্তু খুব ভয় পেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন “মোমেন, এ যাত্রায় পার পেয়ে গেলাম, পাকিস্তানী মাথামোটা বেকুব সোলজারদের কারণে। মনে হয় একসাথে এত বেশি ঔষধ নেয়া যাবে না। কম করে নিতে হবে। শিলার গাড়িটি আর এই ডাক্তারের সাইনগুলো আমাদের আজ রক্ষা করেছে। তুমি সাবধানে থাকবে”।
প্রতিবছর যখন বুদ্ধিজীবী দিবস আসে তখন গিয়াস ভাইর কথা মনে পড়ে। এরকম একনিষ্ঠ প্রতিভা যার ধমনিতে শিরায় শিরায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, প্রায়ই বলতেন “আমি আশাবাদী। এই দ্বিখন্ডিত পাকিস্তান ঠিকে থাকতে পারে না, পারবে না। ধর্মের দোহাই দিয়ে ন্যাশনাল ইন্টিগ্রিটি হয় না, ইতিহাস তার সাক্ষী। তিনি ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। আজকে বুদ্ধিজীবী দিবসে তাঁর মাগফেরাত কামনা করি ।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখকঃ ড. এ কে আব্দুল মোমেন, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫