সর্বশেষ

রহমান বাঙ্গালি’র মতামত কলাম

শেখ হাসিনার নীরব প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩০
শেখ হাসিনার নীরব প্রত্যাবর্তন

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। সেখান থেকে রয়টার্স–কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল ‘আওয়ামী লীগ’-কে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সেহেতু তিনি সতর্ক করে বলেছেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বাদ দেওয়া হলে, সেই নির্বাচনের পর গঠিত কোনো সরকারের অধীনে তিনি আর দেশে ফিরবেন না। এটি কেবল একজন সাবেক নেতার ক্ষোভ নয় বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক যুগের পরিসমাপ্তি এবং গণতন্ত্রের মূল কাঠামোর উপর সরাসরি আঘাতের প্রতিফলন।

 

স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়; এটি রাষ্ট্রের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন-প্রতিটি অধ্যায়ে নির্ধারকের ভূমিকা ছিল দলটি। এমন একটি দল নির্বাচনের বাইরে থাকলে, বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক সংকট নয়; এটি গণতন্ত্রের ভিত্তির ওপর সঙ্কটের পূর্বাভাস। নির্বাচনের বৈধতা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচন হয় না; এটি গণতন্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা।

 

দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, তাঁর নির্বাসন কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসের প্রতীক। তিনি বলেছেন, “আমি এমন কোনো সরকারের অধীনে দেশে ফিরব না, যা বৈধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নয়।” তিনি এটিকে নিজের ‘নৈতিক অবস্থান’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন- যা একটি অবৈধ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদের রূপ। এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্থায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তাঁর ভাষায়, আওয়ামী লীগ কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা মানে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো। এ প্রেক্ষাপটে তাঁর বক্তব্য কেবল ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অবস্থান নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ও আইনগত স্বীকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকাশ। পাশাপাশি এই যুক্তি দিয়ে তিনি দল সহায়ক ভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি পুনরায় সংগঠিত করার প্রান্তিক অবস্থান তৈরি করলেন। এক অর্থে, তিনি বলছেন- ‘‘আমরা বাদ পড়লে পুরো প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হবে”। এটি একটি রাজনৈতিক অনুরোধ অথবা হুশিয়ারিও বটে। কারণ, নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বাদ পড়লে এই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় যে বিভাজন তৈরি হবে তার প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ বলেই ইঙ্গিত দেন তিনি।

 

শেখ হাসিনা আরও উল্লেখ করেছেন, তাঁর দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হবে নতুন প্রজন্মের হাতে; তবে শুধু সেই ক্ষেত্রে যেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া বৈধ ও গণতান্ত্রিক হবে। এটি কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই নয়; দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতির মধ্যেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। নয়াদিল্লি তাঁর অবস্থানকে রাজনৈতিক আশ্রয় হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তাঁর পুনরাগমন বা রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ এখনো নেয়নি। অর্থাৎ, কোনো নেতা বা দল নয়; রাষ্ট্রের স্বার্থই স্থায়ী। এই পরিস্থিতিতে বিদেশী গণমাধ্যমে দেয়া তাঁর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র- মায়ানমার,পাকিস্তান, চীন এবং ভারত সকলের কূটনৈতিক হিসাব- নিকাশকে প্রভাবিত করবে।

 

নির্বাচন, রাজনৈতিক আলোচনায় অন্তর্ভুক্তি, সরকারি দল, বিরোধী দল, অধিকার এসব বিষয় ইতিমধ্যেই অভ্যন্তরীণভাবে উত্তপ্ত দেশ। এই পরিস্থিতি দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। কারণ, ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু কন্যার এই সাক্ষাৎকার কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটকে অতিক্রম করে এটি আঞ্চলিক ভারসাম্য ও শক্তি সমীকরণের একটি নতুন অধ্যায় সূচিত করবে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন। কারণ, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন মানে কেবল রাজনৈতিক বৈধতার পরীক্ষা নয়; এটি গণতন্ত্রের স্থায়িত্বেরও পরীক্ষা। নির্বাচনের ফলাফল শুধুমাত্র ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস নির্ধারণ করবে না বরং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, জনগণের আস্থা এবং আঞ্চলিক কূটনীতির ওপরও স্থায়ী প্রভাব ফেলবে।

 

চীনের দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট অনেক গুরুত্ব বহন করে। বন্দর, অবকাঠামো, বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক প্রকল্পে চীনের গভীর স্বার্থ রয়েছে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চীনের জন্য অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ। মায়ানমার সংলগ্ন রোহিঙ্গা সংকট ও সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়েও চীন সরাসরি নজর রাখছে। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও জড়িত। ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ কেবল একটি অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক পরীক্ষা নয়; এটি বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে মায়ানমার সংকটকে কেন্দ্র করে, কৌশলগত প্রভাব এবং সামরিক-মানবিক পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত।

 

শেখ হাসিনার বক্তব্য রাজনৈতিক প্রতিসাম্য, আঞ্চলিক কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থের সংযোগের প্রতিফলন ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি সমীকরণে-ভারত, পাকিস্তান, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য নয়; এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং মানবিক স্বার্থের জন্যও কেন্দ্রীভূত। ক্ষমতা, গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থ-এই তিনটি স্তম্ভে নির্ভরশীল এই সংকটের সমাধান কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়; এটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক কূটনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে হতে হবে।

 

দেশ এখন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার বক্তব্য মূলত নিজের রাজনৈতিক বৈধতা ও দলের পুনঃঅংশগ্রহণের দাবিকে শক্ত করেছেন এবং একই সাথে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে আসার পথ খোলা রেখেছেন। তাই, আগত নির্বাচন কেবল ক্ষমতার নয়, গণতন্ত্রেরও পরীক্ষা। যদি এই পরীক্ষায় ব্যর্থতা ঘটে, তবে নির্বাসিত নেত্রী সীমান্তের ওপারেই নয়, ইতিহাসের পাতাতেও একটি নীরব স্মারক হয়ে থাকবেন, যেখান থেকে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হতে পারে।

সব খবর

আরও পড়ুন

রাজনীতির সার্কাসে সোনার বাংলায় নামিতেছে শীত, আতঙ্কের জনপদ

ব্যঙ্গ কলাম রাজনীতির সার্কাসে সোনার বাংলায় নামিতেছে শীত, আতঙ্কের জনপদ

রয়টার্সের প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ, বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে হুমকি—বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীনতা নতুন সংকটে

মতামত রয়টার্সের প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ, বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে হুমকি—বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীনতা নতুন সংকটে

দূষিত পানি খেয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা

চট্টগ্রাম কারাগারে ভয়ংকর মানবিক সংকট দূষিত পানি খেয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা

নারীপ্রেমে উন্মত্ত জামায়াত: তিন শূন্যের মহাপরিকল্পনা

ব্যঙ্গ কলাম নারীপ্রেমে উন্মত্ত জামায়াত: তিন শূন্যের মহাপরিকল্পনা

নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় হচ্ছে না নির্বাচন

মতামত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় হচ্ছে না নির্বাচন

শান্তির দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি কেন?

মতামত শান্তির দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি কেন?

পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলে নিরাপত্তা ঝুঁকি, সতর্ক নজরদারি জরুরি

মতামত পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলে নিরাপত্তা ঝুঁকি, সতর্ক নজরদারি জরুরি

আর্মচেয়ার প্রবৃত্তির আর্মচেয়ার নেশন: ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনোকালে?

মতামত আর্মচেয়ার প্রবৃত্তির আর্মচেয়ার নেশন: ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনোকালে?