সর্বশেষ

হীরালাল সেন

সেলুলয়েডে শুরু, আগুনে বিস্মৃতি

বিনোদন ডেস্ক বিডি ভয়েস
প্রকাশিত: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ২১:৩৪
সেলুলয়েডে শুরু, আগুনে বিস্মৃতি

উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম আলোর নাম হীরালাল সেন। ১৮৬৮ সালের ২ আগস্ট মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে জন্ম নেওয়া এই স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ, যিনি প্রথমবার জীবন্ত ছবির জাদুতে গল্প বলার সাহস দেখিয়েছিলেন।

 

১৮৯৭ সালে কলকাতার রাজপথে যখন বায়স্কোপের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন হীরালাল সেন ছিলেন একজন কৌতূহলী দর্শক। স্টার থিয়েটারে স্টিভেনসনের বায়স্কোপ প্রদর্শনী দেখে তিনি শুধু মুগ্ধ হননি, বরং নিজেই ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। মায়ের কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকায় কিনেছিলেন ক্যামেরা ও সরঞ্জাম, গড়ে তুলেছিলেন ‘এইচ. এল. সেন অ্যান্ড ব্রোস’ স্টুডিও।

 

১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল ক্লাসিক থিয়েটারে তিনি প্রথমবারের মতো প্রোজেক্টরে ছবি দেখান। এভাবেই জন্ম নেয় ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’, উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী সংস্থা। বিদ্যুৎ না থাকায় গ্যাস ও অক্সিজেনভরা রবার ব্যাগে আলো জ্বালানো হতো। একবার সেই ব্যাগ ফেটে গেলে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার লাফোঁর পরামর্শে স্টিলের ট্রাঙ্ক ব্যবহার শুরু হয়।

 

হীরালাল সেন শুধু প্রদর্শক ছিলেন না, ছিলেন নির্মাতা। ক্লাসিক থিয়েটারের অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে মিলে তিনি প্রথম নাট্যচিত্র ‘ভ্রমর’ ধারণ করেন। এরপর ‘আলিবাবা’, ‘হরিরাজ’, ‘দোললীলা’, ‘সীতারাম’, ‘মৃণালিনী’, ‘বুদ্ধ’, ‘সোনার স্বপ্ন’সহ অসংখ্য নাট্যচিত্র নির্মাণ করেন। সংবাদচিত্রেও তিনি ছিলেন অগ্রগামী—বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, দিল্লির করোনেশন দরবার, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিছিল—সবই তার ক্যামেরায় বন্দি।

 

তিনি ভারতের প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা হিসেবেও পরিচিত। ‘জবাকুসুম তেল’ ও ‘সালসা পিলা’র বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেন, যা পণ্যের বিক্রি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

 

তবে সাফল্যের পরেও হীরালালের জীবন ছিল সংগ্রামের। ম্যানেজারের প্রতারণা, ভাইয়ের সঙ্গে বিরোধ, সরকারি নিষেধাজ্ঞা সব মিলিয়ে ভেঙে পড়ে ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ক্যামেরা বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়। জীবনের শেষ পর্বে ‘লন্ডন বায়োস্কোপ’ কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।

 

১৯১৭ সালের ২৪ অক্টোবর দুর্গাপূজোর মহানবমীর দিন মতিলাল সেনের বাড়িতে আগুন লাগে। সেই আগুনে পুড়ে যায় হীরালালের সমস্ত চলচ্চিত্র, নেগেটিভ, ইতিহাস। পাঁচদিন পর, ২৯ অক্টোবর, নিঃশব্দে নিভে যায় হীরালাল সেনের জীবনপ্রদীপ।

 

আজও তার নাম অনেকের অজানা। অথচ তিনিই ছিলেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শক, নির্মাতা, সংবাদচিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্রের পথিকৃৎ। আগুনে হারানো সেই সেলুলয়েডের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক বিস্মৃত ইতিহাস—যেখানে আলো আর ছায়া মিলেই গল্প বলে, আর সেই গল্পই হয়ে ওঠে কালজয়ী।

সব খবর