সর্বশেষ

৭০ বছরে পথের পাঁচালীঃ সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি

প্রকাশিত: ২৭ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:০৯
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি এক অনন্ত যাত্রার শুরু। এই সিনেমার মাধ্যমেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার। আর বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল এমন এক ঐতিহ্যের ভিত, যার ওপর দাঁড়িয়ে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য অমূল্য কাজ।
৭০ বছরে পথের পাঁচালীঃ সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি

বিশ্ব চলচ্চিত্রে শতাব্দী-সেরার তালিকায় জায়গা পেল সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সংবাদ বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘টাইম’ এই তালিকা তৈরি করেছে। তালিকায় শুধু একটি ভারতীয় সিনেমাই জায়গা করে নেয়। ১৯২০’র দশক থেকে ২০১০’র দশক, এই ১০০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যত চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, সেই বিশাল ভাণ্ডার থেকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একশোটি চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছে টাইম।


আজ সেই সিনেমার বয়স ৭০ বছর হলো। ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’। এটি শুধু বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নয়, সমগ্র ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতিপথেই এক যুগান্তকারী মোড় এনেছিল।
 

 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘পথের পাঁচালী’ ছিল গ্রামীণ জীবনের এক নির্মোহ কাব্যচিত্র। দরিদ্র পরিবারের টিকে থাকার লড়াই, অপু-দুর্গার নিষ্পাপ শৈশব, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। সবকিছু মিশে ছবিটি হয়ে উঠেছিল এক সার্বজনীন মানবকাহিনি। সেই সময়কার মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির বাইরে এসে সত্যজিৎ দেখিয়েছিলেন, সিনেমা কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং জীবনের গভীর সত্যকে ধারণ করার এক শিল্পরূপ। বলা যায়, ‘পথের পাঁচালী’ ছিল ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার জন্মলগ্ন। সত্যজিৎ প্রমাণ করেছিলেন, বিপুল বাজেট বা সাজসজ্জা ছাড়াও গভীর মানবিক বোধ এবং সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বিশ্বমানের শিল্পকর্ম সৃষ্টি করা সম্ভব।


আজ ৭০ বছর পরও ছবিটি দেখে বিস্মিত হতে হয়—কী অদ্ভুত সতেজ লাগে প্রতিটি দৃশ্য! শিশুদের হাসি, প্রান্তিক মানুষের আশা-নিরাশা, প্রকৃতির ছন্দ—সবই আজও আমাদের ছুঁয়ে যায়। কারণ, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে জীবনের চিরন্তন সত্য। আজও অপুর বিস্মিত চোখে দেখা পৃথিবী, দুরন্ত দৌঁড়ে ছুটে চলা দুর্গা কিংবা ঝড়-বৃষ্টির ভেতর মায়ের সংগ্রাম আমাদের নাড়া দেয়। কারণ এই কাহিনি কেবল বাংলার নয়, এটি জীবনের চিরন্তন গল্প।

 


প্রথম মুক্তির পরই সিনেমাটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতে আলোড়ন তোলে। কান চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে সম্মাননা লাভ করে ‘পথের পাঁচালী’। ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার ভিত্তি স্থাপিত হয় এই সিনেমার হাত ধরেই। সীমিত বাজেটেও সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছিলেন—শিল্পের মূল শক্তি বস্তুনিষ্ঠতা ও মানবিকতা।
 

সত্যজিৎ রায়ের এই প্রথম সিনেমাই তাঁকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, যিনি পরবর্তীতে বিশ্বসিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এটি এক অবিস্মরণীয় সম্পদ, আর আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গর্ব। ৭০ বছর পূর্তিতে আবারও মনে করিয়ে দেয়—‘পথের পাঁচালী’ শুধু একটি কাহিনী নয়, এটি মানবজীবনের অনন্ত যাত্রারই চলচ্চিত্ররূপ। আজও এই চলচ্চিত্র আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গর্ব এবং আগামী প্রজন্মের জন্য এক চিরন্তন শিক্ষার উৎস। 
 

 

সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি এক অনন্ত যাত্রার শুরু। এই সিনেমার মাধ্যমেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার। আর বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল এমন এক ঐতিহ্যের ভিত, যার ওপর দাঁড়িয়ে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য অমূল্য কাজ।
 

৭০ বছর পূর্তির এই মুহূর্তে বলা যায়—পথের পাঁচালী কেবল ইতিহাস নয়, এটি এখনো বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও তার প্রাসঙ্গিকতা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

সব খবর