দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হয়রানি, মামলা ও হত্যার ঘটনা গত ১৫ মাসে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৭৬টি ঘটনায় মোট ১,০৭৩ সাংবাদিক বিভিন্ন রকম দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন।
টিআইবি মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে “দ্য স্টেট অব মিডিয়া ইন পোস্ট-অথরিটারিয়ান বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২৫৯টি ঘটনায় ৪৫৯ জন সাংবাদিককে হামলার মুখে পড়তে হয়েছে। এছাড়া ৮৯টি ঘটনায় ৯৯ জন হুমকির, ৩০টি ঘটনায় ৭০ জন হয়রানির এবং ১৯টি ঘটনায় ২৭ জনকে আটক করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬ জন সাংবাদিককে হত্যা, ১৭ সাংবাদিকের পরিবার বা বাসায় ৯টি হামলার ঘটনা, এবং ১৮৯ জনকে একাধিক ঘটনায় চাকরি থেকে বরখাস্ত বা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে (৩৫%), এরপর চট্টগ্রাম (১৪%) ও খুলনা (১১%)।
এ উপলক্ষে টিআইবি পাঁচ বিভাগে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারও ঘোষণা করে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের সনদ, ক্রেস্ট এবং ১,২৫,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ টাকা প্রদান করা হয়।

আরআরএজি: ইউনূস সরকারের অধীনে সহিংসতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে
এদিকে ৪ আগস্ট, ২০২৫ এ ‘রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ’ (আরআরএজি) প্রকাশিত “বাংলাদেশঃ মিডিয়া ফ্রিডম মার্ডার্ড বাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ৮৭৮ সাংবাদিক টার্গেটের শিকার, যা আগের বছরের তুলনায় ২৩৮% বেশি।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, এ সময়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১৯৫টি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে যা আগের বছরের ৩৫টির তুলনায় ৫৫৮% বৃদ্ধি। এছাড়া ১৬৭ জনের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল, বিএফআইইউর তরফ থেকে ১০৭ সাংবাদিককে নোটিশ, এবং ৪৩১ জনকে হামলা বা হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে।
আরআরএজির তথ্যমতে, ২৭ জুলাই তিন সিনিয়র সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আগেই সব ডিএসএ মামলার প্রত্যাহার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, একজন সাংবাদিককে ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর যাওয়ার পর চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এটিকে ‘উদ্বেগজনক প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কাঠামো নিয়ে উদ্বেগ
আরআরএজি দাবি করে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে “সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস” নামে একটি কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, যা বাস্তবে “গোপন সেন্সরশিপ ব্যবস্থা” হিসেবে কাজ করছে। সংস্থাটি বলছে, এ ইউনিট গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং সরকারি অবস্থানকে “একমাত্র সত্য” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ কাঠামো গঠনে যুক্তরাজ্যের ফরেইন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (FCDO) থেকে £৪৭৪,৪৬৮ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা আরআরএজির মতে গণমাধ্যম স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দৃষ্টান্ত।
দুটি প্রতিবেদনে সার্বিকভাবে দেখা যায়, সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা, মামলা, প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানিক সেন্সরশিপ সবকিছুই ইউনূস সরকারের সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন, গণমাধ্যমের প্রতি এই দমনমূলক পরিবেশ অব্যাহত থাকলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক কাঠামো গভীর সংকটে পড়বে।